বিসিএস পরীক্ষায় নতুন মাত্রা

বিসিএস পরীক্ষায় নতুন মাত্রা

  • আলী ইমাম মজুমদার

বিসিএসের প্রতি চাকরিপ্রার্থীদের আগ্রহ বাড়ছেবাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। আবেদন করেছেন প্রায় ৩ লাখ ৪৭ হাজার পরীক্ষার্থী। এর ঠিক আগে ৩৭তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার। হঠাৎ করে লক্ষাধিক প্রার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ একটু তলিয়ে দেখা দরকার। তা ছাড়া এবার থেকে চালু করা হয়েছে লিখিত পরীক্ষায় দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি। ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম আগেও ছিল। এবার প্রচার একটু জোরদার করায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা ভিন্ন মাত্রা লক্ষ করা যায় ৩৮তম বিসিএসে।

প্রথমেই দেখা দরকার প্রায় ৪০ শতাংশ প্রার্থী বেড়ে গেল কেন। এর বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে। এতে মতামত যা এসেছে তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়, বর্তমান বেতন স্কেল সরকারি চাকরিকে কিছুটা আকর্ষণীয় করেছে। এসব চাকরির স্থায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদাও আকর্ষণের পেছনে অবদান রাখছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তা ছাড়া জনবহুল এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত সরকারই সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কমায় একজন প্রার্থী একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারছেন। তার ওপর চাকরিতে নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অনিয়ম চলে, সে বিবেচনায় সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) অধিকতর নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বলে অনেকে মনে করেন। শূন্য পদ পূরণের ক্রমবর্ধমান চাপে প্রকৃত ঘোষিত পদের চেয়ে শেষাবধি নিয়োগ পান আরও বেশি। নন-ক্যাডারের কিছু পদও সংযোজিত হয়। সবকিছু মিলিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় এত প্রার্থীর আবেদনকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। তবে এ পরিস্থিতি পিএসসির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।

পিএসসি এবার থেকে লিখিত পরীক্ষায় দ্বৈত পরীক্ষক ব্যবস্থা চালু করে চ্যালেঞ্জটা আরও জোরদার করল। সুষ্ঠু মূল্যায়নের বিবেচনায় এ ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে মূল্যায়ন কার্যক্রমে যাতে মোটামুটি আগের সময়সীমাতেই দ্বিগুণ কাজ হয়, তা নিশ্চিত করা সমীচীন। পরীক্ষার্থীর পাশাপাশি উপযুক্ত পরীক্ষকও অনেক বেড়েছেন। সে বিবেচনায় পরীক্ষকদের তালিকা যথেষ্ট প্রসারিত করা দরকার। লিখিত পরীক্ষার পরপরই পরীক্ষকদের কাছে খাতা পাঠানো এবং তা সময়মতো মূল্যায়নের জন্য তাগিদ দেওয়ার পর্বটির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জোরদার করা আবশ্যক। যাঁরা সময় দেওয়ার ব্যাপারে অনুদার এবং ভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁরা বরণীয় আর স্মরণীয় হলেও এ চ্যালেঞ্জের মুখে ‘ব্যর্থ নমস্কারে’ ফেরাতে হবে। কমিশনের যথোপযুক্ত প্রশ্নকারক, মডারেটর ও পরীক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা আবশ্যক। পাশাপাশি নতুন পদ্ধতিতে দ্বৈত পরীক্ষক ব্যবস্থা চালুর ফলে সৃষ্ট সময়স্বল্পতার মাঝেও মূল্যায়নের যথার্থতার বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া দরকার। এমনটা করতে না পারলে উদ্দেশ্যটি প্রশ্নের মুখে পড়বে। অন্যদিকে এটা করতে গিয়ে মূল্যায়ন অস্বাভাবিক বিলম্বিত হলে নেমে আসবে হতাশা। বছরের পরীক্ষা বছরে নেওয়ার দাবি থেকে আমরা সরে আসতে পারি না। আলোচনা প্রাসঙ্গিক যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি নতুন সংযোজন। তাই এর সাফল্যের ওপর নির্ভর করবে ব্যবস্থাটি টিকে থাকা।

যাঁরা ইচ্ছুক তাঁরা ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে পারেন। তাঁদের জন্য প্রশ্নও করা হয় ইংরেজিতে। পরীক্ষার্থীস্বল্পতার জন্য বিষয়টি একরকম চাপা পড়তে যাচ্ছিল। পিএসসির জোরদার প্রচারণায় এবার কিছুসংখ্যক প্রার্থী ইংরেজি মাধ্যম বেছে নিয়েছেন। সংখ্যার তুলনামূলক বিচারে তাঁরা বেশ কম। তবে উত্তরোত্তর বাড়বে। আর তা বাড়াও উচিত। মূলত শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েদের বড় অংশ এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে। তাদের একটি ভাগ ইংল্যান্ড থেকে পরিচালিত ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় পাস করে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হয়। আর ইদানীং মূল ধারার বেশ কিছু স্কুল-কলেজ আমাদের শিক্ষা বোর্ড প্রচলিত সিলেবাসই ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়িয়ে থাকে। উভয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্ব সম্পন্ন করেন ইংরেজি ভাষায়। তাঁদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এদের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। এ বোধ থেকে পিএসসি বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছে। তবে অন্যদের মতোই তাঁদেরও ২০০ নম্বরের আবশ্যিক বাংলা পরীক্ষা দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজি মাধ্যমের জন্য বাড়তি কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। উল্লেখ্য, আমাদের দরকার বাংলা ও ইংরেজি শুদ্ধ ও সাবলীলভাবে বলতে ও লিখতে পারেন এ ধরনের কর্মকর্তা।

দেখাই যাচ্ছে বিসিএস পরীক্ষাটি তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। ৩ লাখ ৪৭ হাজার পরীক্ষার্থী লড়ছেন সাকল্যে ২ হাজার ২৪টি পদের জন্য। এসবের মধ্যে সাধারণ ক্যাডারগুলোতে পদসংখ্যা মাত্র ৫২০। কারিগরি ও বিশেষায়িত এবং শিক্ষা ক্যাডারের পদ যথাক্রমে ৫৪৯ এবং ৯৫৫। এখনো পিএসসির বাছাই কার্যক্রম চূড়ান্ত হয়নি। তবে প্রাথমিক পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা যায়, সাধারণ ক্যাডারেই প্রার্থী আড়াই লাখের কম হবে না। অথচ পদসংখ্যা এর ০.২ শতাংশ। প্রতিযোগিতার তীব্রতা সহজেই অনুমেয়। মোট প্রায় সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর খুব কমসংখ্যকই লিখিত পরীক্ষার সুযোগ পান। বেশি হলে লিখিত ও পরবর্তী সময়ে মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে পড়তে পারে। সময় যাবে অনেক বেশি। তাই পিএসসি প্রিলিমিনারিতে সীমারেখা টানে। এটা মাত্র ২০০ নম্বরের পরীক্ষা। প্রাপ্ত নম্বর পরবর্তী সময়ে অন্যান্য নম্বরের সঙ্গে যোগও হয় না। তবে মূল প্রতিযোগিতায় আসার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।

এরপর থাকছে মেধাতালিকা তৈরি প্রসঙ্গ। এখানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর যোগ করে সে তালিকা হবে কয়েকটি খণ্ডে। সাধারণ ক্যাডারের একটি ছাড়াও বেশ কিছু ভাগে তৈরি করতে হবে কারিগরি ও বিশেষায়িত এবং শিক্ষা ক্যাডারের মেধাতালিকা। কারিগরি ও বিশেষায়িত অংশে চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, কৃষি, মত্স্য, প্রাণিসম্পদসহ বিভিন্ন ক্যাডারের জন্য পৃথক তালিকা করতে হবে। তেমনি বহু বিষয়ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন তালিকা হবে শিক্ষা ক্যাডারের। তারপর সেসব তালিকায় প্রাধিকার কোটার প্রার্থীরা চিহ্নিত হবেন। মেধায় ৪৫ শতাংশ পদ বাদে বাকি সব যাবে প্রাধিকার তালিকায়। এর সবচেয়ে করুণ শিকার সাধারণ ক্যাডারের প্রার্থীরা। আকর্ষণীয় চাকরিগুলোর বেশ কিছু সম্মিলিত (সাধারণ) মেধাতালিকার তলানিতে থেকেও কেউ কেউ প্রাধিকারের জোরে স্থান পান। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অন্যায্য কোটা-ব্যবস্থা সংস্কারের কোনো ধারই ধারছে না।

অবশ্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কর্তৃত্ব পিএসসির নয়, সরকারের। তবে পিএসসি এ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কুফল সম্পর্কে বারবার সরকারকে অবগত করতে পারে। আর বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের দিনবদলের সনদ নামক নির্বাচনী কর্মসূচিতে চাকরিতে নিয়োগে মেধাকে গুরুত্ব দেওয়ার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করেছিল। বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১২ সালে সরকারের জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রে তারা এ অঙ্গীকার আবার করেছে। এগুলো থাকছে কথার কথা। অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের ফেলে রেখে আমরা তুলনামূলক কম মেধাবীদের নিয়োগ দিচ্ছি সব পদে। স্বাধীনতার পর থেকে যে বিভক্তিরেখা টানা হয়েছিল তার সময়সীমা প্রসারিত হচ্ছে। চাহিদার সঙ্গেও এ প্রাধিকার কোটা সংগতিহীন। তদুপরি সংবিধানের প্রদত্ত প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে সমান সুযোগ লাভের যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তারও ব্যত্যয় বটে। এ রকম ব্যত্যয়ের বিধান রয়েছে শুধু পশ্চাৎপদ অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর জন্য। এসব কিছু বিবেচনায় না নিয়েই তুলনামূলকভাবে অধিক মেধাবীদের দূরে ঠেলে রাখার ব্যবস্থা অনেকটা স্থায়ী রূপ পেয়েছে।

বলা হচ্ছে, কোনো পদে প্রাধিকারসম্পন্ন প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধাতালিকা থেকে তা দেওয়া হয়। আর এমনটা দেওয়া সম্ভব হয় সাধারণত কারিগরি ও বিশেষায়িত এবং শিক্ষা ক্যাডারের কিছু সাব ক্যাডারে। সাধারণ ক্যাডারে সম্ভব হয় না। ফলে এ তীব্র প্রতিযোগিতার বিভিন্ন স্তর পাড়ি দিয়ে অধিক মেধাবীদের একটি বড় অংশ ফিরে খালি হাতে বা একটি নন-ক্যাডার পদ নিয়ে। অথচ তারা তো বকশিশ চায় না। চায় হিসাবের পাওনাটুকু। এ ক্ষেত্রে বলা চলে বিসিএস এ নতুন মাত্রার ছাপ পড়েনি কোটা-ব্যবস্থায়।

এত সব সত্ত্বেও নতুন মাত্রায় বিসিএসের এ যাত্রার সাফল্য কামনা করছেন সবাই। এখানে চাকরিপ্রার্থীদের যে ভিড় বাড়ল তা একটি আস্থার পরিবেশেরও পরিচায়ক বলে ধরে নেওয়া যায়। পিএসসি বিভিন্ন আঙ্গিকে এ আস্থাটুকু ধরে রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেবে এ প্রত্যাশা রইল।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment