সিনিফার ডিভাইস ও একজন রেজাউলের গল্প

সিনিফার ডিভাইস ও একজন রেজাউলের গল্প

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

প্রায়ই খবরের কাগজে ছাপা হয় গ্যাসের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার খবর।  আর এই দূর্ঘটনাগুলো হয় রান্না ঘরের গ্যাস থেকেই বেশি। তিতাসের সমীক্ষা মতে, এই ধরনের দুর্ঘটনা ২০১৩-১৪ সালে ছিল ৩,৮১৯টি। ২০১৪-১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,১২৩। ফায়ার সার্ভিসের অভিজ্ঞতাও বলছে একই কথা। এই হিসাব মতে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রতি ২ ঘণ্টায় ১টি! অর্থাত্ প্রতি দুই ঘণ্টায় আমাদের একটি পরিবার এমন দুর্ঘটনায় মুখোমুখি হন। এমন খরব দেখে রেজাউল কবিরের একটি ইচ্ছা জাগ্রত হয়। কীভাবে এই অগ্নি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যায়? তার এই ইচ্ছা বাস্তবায়নে সময়ও লাগে অনেক। অবশেষে তিনি আবিষ্কার করেন একটি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস। এই ডিভাইসটি গ্যাসের গন্ধ পেলে নিজে নিজেই চ্যাঁচিয়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে রেজাউল কবির বলেন,‘আইডিয়াটা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম আমার এক বন্ধুর অনুরোধে, যিনি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। একদিন ফোন দিয়ে বলে ‘ব্যাটা এতসব সফিস্টিকেটেড জিনিস নিয়ে কাজ করছিস অথচ ছোট একটা প্রবলেম সমাধান করতে পারছিস না!’ বিষয়টা কী জানতে চাইলে উত্তরার দুর্ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বছর খানেক আগেই উত্তরায় একটি দম্পতি দু-দুটি সন্তানসহ রান্নাঘরের গ্যাস নিঃসরণজনিত দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। রাতভর রান্নাঘরের চুলা থেকে গ্যাস নিঃসরণ হয়ে ঘর ভরে গিয়েছিল। সকালে চুলা জ্বালাতেই ঘটে যায় দুঃখজনক এই দুর্ঘটনাটি।’ এরপর থেকে শুরু হয় রেজউল কবিরের কার্যক্রম।

ডিভাইসটি বানানো শেষ হলে শুরু হয় ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপার নিয়ে ভাবনা। এ বিষয়ে রেজাউল কবির বলেন, ‘পণ্য হিসেবে এটি ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে যাবে। না হবে ব্যবসা, না হবে জীবন রক্ষা। তাই সঠিক সেবা দিতে হলে এটাকে বাণিজ্যিকভাবে সফল হতেই হবে। শুরু করলাম ক্রেতার কাছে পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ল্যাবে একটা প্রটোটাইপ বানানো আর বাণিজ্যিকভাবে তা ক্রেতার কাছে গ্রহণযোগ্য করে বাজারজাত করা মোটেই এক কথা নয়। বাণিজ্যিক ভাবে সফল হতে হলে পণ্যের উপকারি বৈশিষ্ট্যের সাথে এর উপস্থাপনাও হতে হবে আকর্ষণীয়।’

ডিভাইসটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে কাঠ দিয়ে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জলপাই ইলেকট্রনিক্সের সিইও রেজাউল কবির বলেন, ‘এনক্লোজার বা কেসিং বানাতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। প্লাস্টিক ইনজেক্টেড মোল্ড নিয়ে কাজ করে এরকম বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠান থেকে নমুনা নিয়ে কোনোভাবেই উন্নতমানের একটা কেসিং বানাতে পারলাম না। একেতো খুবই নিম্ন মানের প্লাস্টিক তার উপরে চড়া দাম। কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিল না। যেনতেন একটা কিছু করে নিজের পণ্যের মান কমাবো না এটা শুরু থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। দেশে এই ধরনের ডিভাইসের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।’ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই ডিভাইসটির মান কেমন হতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সবকাজ যখন শেষের দিকে তখন হঠাত্ করেই ফাইনাল টেস্টিংয়ে ধরা পড়ল সার্কিটের ছোট ছোট কিছু ত্রুটি। সবকিছু বিবেচনা করে প্রায় এক হাজার মাদারবোর্ড বাতিল করে দিলাম। অনেক টাকার লোকসান। আবার নতুন করে ডিজাইন করে দুইজন বিশেষজ্ঞের কাছে টেস্টিংয়ের জন্য পাঠালাম। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন দেশের অন্যতম একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রিক্যালের হেড অব ডিপার্টমেন্ট। অন্যজন আমার বাল্যবন্ধু ড. এনায়েত, যিনি বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করে বর্তমানে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই রিসার্চ এবং শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত। নিজ নিজ ল্যাবে আলাদা-আলাদাভাবে বিস্তারিত পরীক্ষার পর দু’জনের কাছ থেকেই গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই আমার মূল উত্পাদনের কাজ শুরু করেছি।’ তিনি আরও জানান, কোয়ালিটির দিক থেকে এই পণ্যটি আন্তর্জাতিক যেকোনো পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে প্রস্তুত। কোয়ালিটির দিক থেকে আমরা মোটেও ছাড় দিচ্ছি না। বাকি ব্যপারটা ব্যবহারকারীর উপর ছেড়ে দিলাম।

বর্তমানে দেশের বাজারে এই ডিভাইসটি পাওয়া যাচ্ছে। গত ডিসেম্বর থেকে প্রি-অর্ডার নিয়ে ছিল জলপাই ইলেকট্রক্সি। এই প্রসঙ্গে রেজাউল কবির বলেন,‘ গত বছরের শেষের দিকে আমরা প্রি-অর্ডার নেওয়া শুরু করি। প্রি-অর্ডারের অভাবনীয় সফলতার পর বাণিজ্যিকভাবে কিভাবে পণ্যটি সফল হবে এবং কিভাবে বাজারজাত করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে, কিভাবে কাস্টমারের বাসায় গিয়ে ডিভাইসটি লাগিয়ে দেওয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান।’

দেশে চলমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধান নিয়ে তিনি বরাবরই চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘আমার একার পক্ষে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করা সম্ভব না। এ কারণেই অন্যান্য উদ্যোগক্তাদের প্রতি আমার একটি  ক্ষুদ্র  অনুরোধ—সাহস করে বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসুন। ’

পণ্যটি নিয়ে আগামী পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের ডিভাইস দেশে অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করা উচিত ছিল। আমি বলব না যে, আপনারা আমাদের পণ্যটিই কিনে নেন। আমি বলব, আপনার সচেতন হোন। এই ধরনের একটি ডিভাইসের মাধ্যমে আপনার পরিবার একটি দূর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে। আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে ডিভাইসটির জনপ্রিয়তা বাড়ানো ও জনসচেতনতা বাড়ানো নিয়ে। খুব দ্রুত আমারা তিতাস ও ফায়ার সার্ভিসের সাথে আলোচনায় বসব। তাদের সাথে আমরা জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজে এক সঙ্গে কাজ করতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ডিভাইসটি ব্যবহারে পরিবারের সকলের জীবন-ই বাচবে না দেশে গ্যাসের অপচয়ও রোধ হবে। সুযোগ পেলে আমরা ফ্রি ক্যাম্পেইন করার চেষ্টা করবো। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করে যাবো।’  বিস্তারিত তথ্যের জন্য www.jolpi.io। এছাড়াও যোগাযোগ করতে পারেন ০১৭৭৮০০০০৪৪ এই নম্বরে।

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment