আশায় বসতি গড়ো : বিল গেটস

আশায় বসতি গড়ো : বিল গেটস

বিল গেটস। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা। বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বেসের ২০১৫ সালের তালিকায় বিশ্বের এক নম্বর ধনী ব্যাক্তি তিনি। তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা চালাননি। সফল ড্রপআউট বিল গেটস ২০১৪ সালের ১৫ জুন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই বক্তৃতা দেন। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের ভাষান্তর করেছেন মারুফ ইসলাম


467bb42991800.5601902e8cc30২০১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা, তোমাদেরকে অভিনন্দন! তোমাদের এই ক্যাম্পাস নানা দিক থেকেই অতুলনীয়৷ আমাকে যদি একটি শব্দে বলতে হয় স্ট্যানফোর্ডের কোন বিষয়কে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি, তাহলে বলতে হবে তোমাদের আশাবাদী মানসিকতা৷

এই আশাবাদী মানসিকতা নিয়েই ১৯৭৫ সালে আমি বোস্টনের এক কলেজ ছেড়ে এসে মাইক্রোসফট গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়েছিলাম৷ আমার প্রচণ্ড বিশ্বাস ছিল, কম্পিউটার ও সফটওয়্যার পৃথিবীজুড়ে মানুষের জীবনকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করবে। পৃথিবীকে আরও বেশি উন্নত করে তুলবে এইসব প্রযুক্তি৷ আজ দীর্ঘ সময়ে অতিবাহিত করার পর আমি উপলব্ধি করছি, আমার আশা-আকাঙ্ক্ষার অনেকটাই বদলে গেছে৷ আমি যা শিখেছি, আজ তা তোমাদের বলতে ইচ্ছে করছে৷ আর জানাতে ইচ্ছে করছে, কীভাবে আমরা সবাই আরও অনেক মানুষের জন্য অনেক কিছু করতে পারি৷

পল অ্যালেন আর আমি যখন মাইক্রোসফট শুরু করেছিলাম, তখন আমদের একটাই লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার ও সফটওয়্যারের ক্ষমতাকে কীভাবে গণমানুষের কাজে লাগানো যায়৷ ১৯৯৭ সালে আমি ব্যবসার কাজে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলাম৷ সেখানে একদিন কৌতূহলবশত শহরের একটু দূরে সোয়েটো নামে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। এমন জায়গা এর আগে আমি কখনো দেখিনি৷ মাইক্রোসফট সেখানে একটি কমিউনিটি সেন্টারে কম্পিউটার ও সফটওয়্যার বিতরণ করেছিল, যেভাবে আমেরিকায় আমরা কাজ করতাম৷ কিন্তু আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝে গেলাম, এটা আমেরিকা নয়৷ এর আগে আমি দারিদ্র্যকে যতটুকু দেখেছি সেটা ছিল পরিসংখ্যানের কাগজে দেখা, নিজের চোখে নয়৷ সেখানে গিয়ে আমি দেখলাম, কীভাবে মানুষ বিদ্যুৎ, পানি, টয়লেট ছাড়াই বস্তিতে থাকছে৷ বেশির ভাগের পায়েই কোনো জুতা ছিল না, জুতা পায়ে হাঁটার মতো রাস্তাও ছিল না৷ যে কমিউনিটি সেন্টারে আমরা কম্পিউটার দান করেছিলাম, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা ছিল না৷ তাই তারা ২০০ ফুট লম্বা তার দিয়ে ডিজেলচালিত একটি জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে কম্পিউটার চালিয়ে রেখেছিল৷ অবস্থা দেখে আমি ভালোভাবেই বুঝলাম, যে মুহূর্তে আমি আর আমার সঙ্গের লোকজন চলে যাব, তৎক্ষণাৎ এই জেনারেটরও অন্য কোথাও চলে যাবে৷ আর কমিউনিটি সেন্টারের লোকেরাও তাদের জীবনের অন্য হাজার সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়বে; সেসব সমস্যা কখনো কম্পিউটার দিয়ে সমাধান করা যায় না৷

আগে আমি দারিদ্র্যকে যতটুকু দেখেছি সেটা ছিল পরিসংখ্যানের কাগজে দেখা, নিজের চোখে নয়৷ সেখানে গিয়ে আমি দেখলাম, কীভাবে মানুষ বিদ্যুৎ, পানি, টয়লেট ছাড়াই বস্তিতে থাকছে৷ বেশির ভাগের পায়েই কোনো জুতা ছিল না, জুতা পায়ে হাঁটার মতো রাস্তাও ছিল না৷

গণমাধ্যমের সামনে এসে আমি আগে থেকে তৈরি করে রাখা বক্তৃতা পড়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘সোয়েটো প্রযুক্তির বিভাজনকে ঘুচিয়ে দেওয়ার যাত্রায় একটি মাইলফলকের নাম৷’ কিন্তু মুখে যা-ই বলি না কেন, আমি বুঝতে পারছিলাম, এসব কথায় কোনো সারবস্তু নেই৷

সোয়েটোতে যাওয়ার আগে আমার চিন্তা-ভাবনা ছিল এ রকম যে, আমি পৃথিবীর সমস্যা বুঝি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই, সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো নিয়েই আমার কোনো ধারণা ছিল না৷ আমি এত অসহায় বোধ করছিলাম যে আমি নিজের বিশ্বাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলাম, আদৌ কি উদ্ভাবনের মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব? আমি পণ করলাম, দ্বিতীয়বার আফ্রিকায় পা দেওয়ার আগে আমাকে বুঝতে হবে দারিদ্র্য আসলে কী৷

এর অনেক পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আমি একটি যক্ষা হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম৷ সেটি একটি বিশেষ ধরনের যক্ষা রোগীদের জন্য, যাদের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগেরও কম৷ গোটা হাসপাতাল রোগীদের ভিড়ে উপচে পড়ছে৷ রোগীদের মধ্যে আমি এক নারীর সঙ্গে কথা বললাম, তার বয়স মাত্র ত্রিশের ঘরে৷ সে আগে এক যক্ষা হাসপাতালে কাজ করত, একদিন তার নিজেরও যক্ষা ধরা পড়ে, সঙ্গে এইডস৷ সে জানত, তার দিন ফুরিয়ে এসেছে৷ আর তার মৃত্যুর পর যখন সেই বিছানা খালি হয়ে যাবে, সেখানে জায়গা করে নিতেও রোগীদের এক বিশাল লাইন অপেক্ষা করে আছে৷

1681317-poster-1280-bill-gatesআমি গাড়িতে উঠে সেখানকার এক ডাক্তারকে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি জানি এ ধরনের যক্ষা সারিয়ে তোলা মুশকিল৷ কিন্তু কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয়ই আছে৷ এসব মানুষের জন্য আমাদের কিছু করতেই হবে৷’

আমি আজ আনন্দের সঙ্গে বলতে পারি এ বছর আমরা যক্ষার এক নতুন ধরনের ওষুধের পরীক্ষা করতে যাচ্ছি৷ আগে যেখানে ১৮ মাস ধরে প্রায় দুই হাজার ডলার খরচের পরও শতকরা ৫০ জনের বেশি রোগীকে সুস্থ করা যেত না, এখন সেখানে ছয় মাসের চিকিৎসায় ১০০ ডলারের কম খরচেই শতকরা ৮০ থেকে ৯০ জন রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে৷ এখানেই আশাবাদের শক্তি নিহিত৷

আমি হতাশাবাদীদের দলভুক্ত নই৷ কিন্তু আমাদের স্বীকার করতে হবে যে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে যদি আমরা বৈষম্য দূরীকরণের কাজে না লাগাই, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা এমন সব উদ্ভাবন নিয়ে বসে থাকব, যা পৃথিবীকে আরও বিভক্ত করে ফেলবে৷ উদ্ভাবন দিয়ে কী হবে, যদি তা স্কুলে শিক্ষার মান না বাড়ায়? যদি ম্যালেরিয়া নির্মূল করা না যায়, দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব না হয়, দরিদ্র কৃষকের অন্নের নিশ্চয়তা না থাকে?

গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী বন্ধুরা আমার, তোমরা অসংখ্য উদ্ভাবনের নেতৃত্ব দেবে, পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে৷ তোমাদের বয়সে আমি পৃথিবীকে যতটা চিনতাম, আমি বিশ্বাস করি, আজ তোমরা তার চেয়ে ঢের বেশি জানো৷ আমি যা করেছি, তোমরা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করতে পারবে, যদি তোমরা এতে তোমাদের মনপ্রাণ উজাড় দাও৷ আমি সেই প্রত্যাশায় রইলাম৷

তথ্যঋণ: স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট। favicon

Sharing is caring!

Leave a Comment