কাজপাগল সাদেকা
- লিডারশিপ ডেস্ক
পিতা ফজলুল হালিম চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বাবার স্বপ্নকে ঘিরে কন্যা সাদেকা হালিম একসময় যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম তথ্য কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন সফলভাবে। নিয়মিত টকশোতে যান, কথা বলেন স্পষ্ট ভাষায়। ক্যাম্পাসে শুধু শিক্ষার্থী নয়, অনেক শিক্ষকও তাকে সম্মান করেন তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে। চলনে-বলনে আলাদা ব্যক্তিত্বের ছাপ রাখা এ মানুষটি স্বপ্ন দেখেন একটি চমত্কার সুসংগঠিত ক্যাম্পাসের।
জীবনকে ভালো করে জানার জন্য যে মানুষ আর মানবসৃষ্ট সমাজকে প্রথমে বোঝা উচিত, মানুষকে নিয়েই কাজ করা উচিত সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাই অন্যকিছু নয়, বরং মানুষের জন্য, সমাজের জন্য আর দেশের জন্য কাজ করার শিক্ষা দিতেই ভর্তি করালেন তিনি মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদে।
‘প্রথমটায় খুব কান্না করেছি। মন খারাপ হয়েছে। এত এত শিক্ষার্থীর ভিড়ে অসহায় লেগেছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারি ওটা আমার প্রয়োজন ছিল। বাবা চেয়েছিলেন আমি দেশের জন্য কিছু করি। আমাকে আর আমাদের বোনেদের তাই সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তিনি।’ বাবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে চোখ দুটো খানিকটা ছলছল করে উঠল মেয়েটির।
কী পাননি তিনি জীবনে? কী করার চেষ্টা করেননি? শিক্ষাজীবনের সেই প্রথম থেকে একের পর এক প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে পৌঁছেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায়। বাবার শিক্ষকতা, মায়ের শিক্ষকতা— এসবই সবসময় আদর্শ হিসেবে কাজ করেছিল তার। একে একে স্কলারশিপ পাওয়া, পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করা, শিক্ষক হিসেবে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগদান করা— স্বপ্নগুলো যেন এক এক করে অনেকটাই পূরণ হয়ে গেছে। সবার চোখের সম্মান, পরিবারের মমতা, ভালোবাসা, একমাত্র সন্তানের প্রেরণা— সবকিছু দিয়ে একেবারে ভরভরাট জীবন। কিন্তু তবুও! তবুও কোথায় একটা যেন অপূর্ণতা থেকেই যায় মেয়েটির। আর এ অপূর্ণতা হলো তার জীবনের অন্যতম আদর্শ, অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব— তার বাবা।
‘এ বাড়িতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন) জীবনের আটটা বছর কেটেছে আমার। আজ এতদিন হলো এখানে আসি না। তবু এখানে এলে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। তার সেই সাহসী পদক্ষেপ, নির্ভীক পদাবলির কথা মনে হয়। চোখ দুটো ভিজে যায় বার বার।’ পাশেই বাগানের গোলাপ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে চলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। পুরো বাড়িটায় যেন স্মৃতির খোলস পরানো রয়েছে। গোলাপ গাছগুলো মায়ের হাতের লাগানো। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানান তিনি। অধ্যাপক নয়, বরং সেই প্রায় দুই যুগেরও বেশি আগের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্ছল আর চটপটে ছাত্রীতে পরিণত হয়ে যান তিনি কিছুক্ষণের জন্য।
‘আমি এত সহজে এতকিছু পেয়েছি সেটা দেখলেই কিন্তু হবে না। আমার পেছনে আমার পরিবার ছিল, সঠিক পরিবেশ ছিল বলেই এতটা পেরেছি আমি। আমি এমন এক পরিবার থেকে এসেছি যেখানে সবসময়ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাম্য, কল্যাণমুখী রাষ্ট্র, নারীদের শিক্ষা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। তাই আমার ও আমার বোনেদের পেছনে যতটা প্রেরণা রয়েছে সবটা আমার পরিবার আর আমার বাবার।’ নির্দ্বিধায় নিজের আজকের অবস্থানের সব কৃতিত্ব পরিবারকে দিয়ে দিতে চাইলেন এ শিক্ষক।
খাবারের ক্ষেত্রে এ দেশভক্ত মানুষটির দেশের ডাল, ভাত আর মাছকেই সবচেয়ে ভালো লাগে।
‘আর মায়ের হাতের পায়েস ও হালুয়া। মায়ের হাতের রান্না অসাধারণ। তার সব রান্নাই ভালো। তবে হালুয়াটা সবচেয়ে ভালো খেতে।’ মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন মেয়ে। তবে নিজের রান্না করার কথা আসতেই মুচকি হাসেন।
‘রান্না আসলে একটা শিল্প। অনেক কঠিন বিষয়। সাধনার ব্যাপার। ওটা সবাই পারে না। আমিও পারি না অতটা ভালো। তবে যারা পারে তারা সত্যিই খুব গুণী।’ বলেন তিনি।
তবে এ তো গেল কেবল দেশি খাবারের বর্ণনা। এসব ছাড়াও বাইরের কন্টিনেন্টাল আর ইউরোপিয়ান ডিশগুলো বেশ ভালো লাগে সাদেকা হালিমের। পোশাকের ভিতরে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন শাড়িতে। সেই সঙ্গে বাইরে বেরুবার সময় খানিকটা সুগন্ধি, ঘড়ি আর চশমা না হলে চলে না তার। সুগন্ধির ভিতরে ল্যানকম ও টিনিক বেশি পছন্দ করেন তিনি। সেই সঙ্গে মানানসই একটা সানগ্লাস হলে তো কথাই নেই। শিক্ষক হিসেবে বই পড়ার অভ্যাস তো রয়েছেই। এ ছাড়াও অবসরে গান শুনতে আর বাইরে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন সাদেকা হালিম। মাঝে মাঝে প্রচুর টেলিভিশন দেখা হয়। ভালোবাসেন আড্ডা মারতেও। গানের ব্যাপারে সব সময় রবীন্দ্র সংগীতকেই এগিয়ে রাখেন তিনি। তবে তাই বলে নতুনদেরও বাদ দেন না।
‘আমার একটা ছেলে আছে। ওর কাছ থেকে নতুনদের সম্পর্কে জানি। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে আমাকে জানতে হয়। তাই নতুন শিল্পীদের গানটাও শোনার চেষ্টা করি সব সময়। নতুনেরা আসলে কি চাইছে সেটা বুঝতে চাই।’ তবে নতুনদের গান শোনার কারণ এটা হলেও আগাগোড়াই আড্ডা মারতে বেশ পছন্দ করেন সাদেকা হালিম। চেষ্টা করেন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার। তাদের খোঁজখবর নেওয়ার।
‘বন্ধুরা কেউ স্কুলের, কেউ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে সেটা যেখানকার বন্ধুই হোক, আড্ডা মারতে খুব পছন্দ করি। কারণ এভাবেই দেশের নানা স্থানের নানা খবর জানতে পারা যায়।’ বলেন তিনি।
পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজে দেশের বাইরে অনেকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সাদেকা হালিমের। বেশকিছু দেশ ঘুরেছেন তিনি। তবে দেশের তালিকায় ভালোলাগার দিক দিয়ে বাংলাদেশের পরপরই ভারতকে রাখতে চান এই নারী।
‘ভারতের পরতে পরতে ইতিহাস। আর এটা সত্যি যে, ইতিহাস কথা বলে। ভারতে ঘুরতে তাই সবচেয়ে ভালো লাগে আমার।’ বলেন তিনি। কিন্তু এতটা ব্যস্ততার মাঝে কি পরিবারকে সময় দেওয়ার সুযোগ হয়? জানতে চাইলে হাসেন সাদেকা হালিম।
‘আমার মতো শিক্ষক বা গবেষক যারা, তাদের জীবনে আসলে ঘর আর বাইরে বলতে পৃথক কিছু নেই। দুটোই একসঙ্গে চলে। আমার ঘরজুড়ে লাইব্রেরি রয়েছে। সেখানে কাজ করি আমি। বাইরেও কাজ করি। ঘরে গিয়েও কাজ করি। বিশেষ করে আমার গবেষণাগুলোকে তো সেখানেই পূর্ণতা দিতে হয়। তাই পরিবারকেও সময় দিতে পারি অনেকটা।’ তবে পরিবারকে নয়, দেশকেই বেশির ভাগটা দিতে চান সাদেকা হালিম।
‘জনগণের জন্য আর দেশের জন্য কাজ করতে চাই। আমি পূর্ব ও পশ্চিম সবদিকটাই দেখেছি। আর তাই সবটার মেলবন্ধনে জীবনই আমাকে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদের মতো নয়, কর্মী অধ্যাপক হিসেবেই গড়ে তুলেছি আমি নিজেকে। সব সময় তাই থাকব। আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্র্রদায়, নারী— এ ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ করেছি আমি। আর তাই আমি চাই এমন একটা দেশের জন্য কাজ করতে যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন থাকবে। সবাই ক্ষমতায়িত হবে।’ স্বপ্নালু চোখে নিজের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নিয়ে জানান তিনি। তবে কেবল মুখেই নয়, নিজের কথাগুলো কলমের কালিতেও বইয়ের পাতায় লিখে রাখতে চান সাদেকা হালিম। খুব দ্রুতই তাই লেখার কাজে হাত দিতে চান তিনি।
বাবার স্বপ্ন ছিল দেশকে নিয়ে। দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে একটা সময় স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদকেও ছেড়ে এসেছিলেন তিনি। সেটা দেখেছেন সাদেকা হালিম। দেখেছেন জীবনের নানা পথকে। নানা দিককে। আর তাই তার চোখে দেখা সেই স্বপ্ন আর বাস্তবতাগুলো শুধু বর্তমানকেই নয়, ভবিষ্যত্ প্রজন্মকেও জানানোর, অসম্ভব একটা সুন্দর, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন তিনিও।