যেভাবে অনিল গুরাভ হারিয়ে গেলেন
- রনি আহমেদ
মুম্বাইয়ে অত্যন্ত প্রতিভাবান দু’জন ব্যাটসম্যান ছিলেন। তাদের কোচ ছিলেন রমাকান্ত আচরেকার স্যার। দুজনেরই অজিত নামে এক ভাই ছিল। এক অজিত তার ছোট ভাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করে ইন্ডিয়াকে শচীন টেন্ডুলকার উপহার দিয়েছিলেন। অন্য অজিত অন্ধকার জগতে চলে গিয়েছিলেন এবং সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তার ভাই ও তার সম্ভাব্য দুর্দান্ত ক্যারিয়ারকেও। এই কাহিনিটি সেই দুর্ভাগা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে, যাকে শচীন ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন।
তিনি অনীল গুরাভ। মুম্বাই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতেন। গুরু রমাকান্ত আচরেকার তার ব্যাটিংয়ের অনুরণে এতোটাই মুগ্ধ ছিলেন যে তরুণ টেন্ডুলকার এবং কাম্বলিকে গুরাভের স্ট্রোকপ্লে দেখতে এবং তাঁর কাছ থেকে শিখতে বলতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুরাভের ব্যাটিং করা দেখেছেন শচীনও। অনীল গুরাভের মাকেও গুরু রমাকান্ত আচরেকার খুব করে বলতেন এই ছেলে বড় কিছু হবেই হবে। রমাকান্ত আচরেকার বলতেন অনীল গুরাভ স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের নাকি পুনর্জীবন। সেই সময় তাকে মুম্বাইয়ের ভিভ রিচার্ডস বলে ডাকা হত এবং সকলেই ভেবেছিলেন যে গুরাভই প্রথম ভারতের হয়ে খেলবেন।
শচীনের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়ে গুরাভ বলেন, আমি তার অধিনায়ক ছিলাম সাসানিয়ান ক্রিকেট ক্লাবে। সে আমার ব্যাটটি ব্যবহার করতে চাইত। তবে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে খুব লজ্জা পেত। অনুরোধটি রমেশ পরব (বর্তমানে তিনি ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক স্কোরার) এর মাধ্যমে আসতো। তখন আমি শচীনকে বলেছিলাম যে তিনি যদি বড় স্কোর করতে পারেন। তবে তিনি এটি ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি পারবো স্যার’ এবং আমার এসজি ব্যাট দিয়ে তিনি অনুর্ধ্ব-১৪ দলে সেঞ্চুরি করতে পেরেছিলেন।
তবে পরবর্তীতে গুরাভ ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়েন। তার ভাই অজিত দুষ্কৃতকারীদের জগতে মিলিত হয়ে যান। গুরাভ যখন বাইশ গজে ব্যাট হাতে বোলারদের শাসন করতে ব্যস্ত। বড় ভাই অজিত তখন বন্দুক হাতে মুম্বই শাসন করতে মরিয়া। এক ভাই বোলারদের ত্রাস মাঠে, অন্যজন মানুষের ত্রাস আন্ডার ওয়ার্ল্ডে। মোস্ট ওয়ান্টেড অজিতকে ধরতে মুম্বাই পুলিশ তখন আগ্রাসী। যার ফলে, পুলিশ কর্মকর্তারা বারবার গুরাভ ও তার মাকে ধরে নিয়ে যেত এবং তার ভাই অজিতের হদিস পাবার জন্য তাদের মাঝে মাঝে গুরুতর মারধর করত। কখনও কখনও কয়েক দিনের জন্য তাদের আটক রাখত।
এখানেই তার ক্যারিয়ারের মোক্ষম সময়টা পার হয়েছিল। এই অগ্নিপরীক্ষার অবসান হওয়ার সাথে সাথেই গুরাভের ক্রিকেট ক্যারিয়ারও শেষ হয়েছিল। তিনি মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। সব কিছুই হারিয়ে গেল। তার ক্যারিয়ার, তার স্বপ্নগুলি, সবই যেন ধোঁয়ায় উড়ে গেল।
এছাড়াও টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলে টাকা কামানোর নেশা অর্থাৎ খ্যাপ খেলেও প্রতিভার নিদারুণ অপচয় করেছেন তিনি। গুরু রমাকান্ত আচরেকার বহুবার বাধা দিলেও তার কথা শোনেননি। আর এভাবেই একটু একটু করে শচীনের চাইতে বেশি প্রতিভাধর অনিল গুরাভ হারিয়ে গিয়েছেন।
গুরাভ পরবর্তীতে বলেন, তিনি সর্বশেষ ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে মেরিন লাইনের ইসলাম জিমখানায় শচীনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনি যখন শচীনকে গাড়িতে উঠতে দেখলেন, তখন তার চারপাশ নিরাপত্তার লোকজন দ্বারা বেষ্টিত ছিল। সেখানে শচীন তাকে একবার দেখেই চিনে ফেলে। শচীন তাকে ডেকে কয়েক মিনিট কথা বলেছিলেন এবং তাঁর বাড়িতে আসতেও তাকে বলেছিলেন।
যার নেটে ব্যাটিং করা একটানা দাঁড়িয়ে দেখতেন শচীন তাকে এখন আর চেনা যায় না। যে শহরে বন্ধু শচীন থাকেন সেই মুম্বাইয়ের নালাসোপাড়ার একটি বস্তির ২০০ বর্গফুটের নোংরা ঘরে গুরাভ থাকেন। আর এখানেই সারাক্ষণ মদ্যের নেশায় বিলীন হয়ে থাকেন। বর্তমানে যখন শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেট বিশ্বের একজন কিংবদন্তি হয়েছেন। যিনি প্রায় সব কিছুই অর্জন করেছেন। অন্যদিকে অনিল গুরাভ একজন ৫০ বছর বয়সী মদ্যপ মাতাল।
মানুষের কর্মই তার নিয়তি। আর সেই নিয়তি খুন করে ফেলেছে ক্রিকেট ইতিহাসের এক সম্ভাব্য ধ্রুবতারাকে। কারণ এক অজিত ইন্ডিয়াকে উপহার দিয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার আর আরেক অজিতে নষ্ট হয়েছে শচীনের চাইতেও বেশি প্রতিভাধর অনিল গুরাভের ক্যারিয়ার।