পথ দেখাচ্ছেন জন্মান্ধ শ্রীকান্ত
- মো. সাইফ
জন্মসূত্রে মানুষ অনেক কিছুই পায়, শ্রীকান্ত বোলা পেয়েছিলেন আলোহীন দুটি চোখ। ভারতের হায়দারাবাদের এক গ্রামে তাঁর জন্ম। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন অন্ধ শ্রীকান্ত শুধুই সমাজের বোঝা-এর বেশি কিছু নয়। আদিম যুগে মানুষের বর্বরতার গল্প যে এখনো ইতিহাস হয়ে যায়নি সেটাই বোধহয় তারা প্রমাণ করতে চাইলেন। পরামর্শ দিলেন শ্রীকান্তের মা-বাবাকে, ‘এই ছেলে সংসারের জন্য পাপ। ছোট থাকতে থাকতে মেরে ফেলেন। তাহলে আর পাপের বোঝা বহন করতে হবে না।’ শ্রীকান্তের মা-বাবা এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলেন না। সন্তান যেমনই হোক পিতা-মাতার কাছে সে রাজপুত্র।
রাজপুত্রের চাইতেই বা কম কি ! শ্রীকান্তকে সৃষ্টিকর্তা চোখের দৃষ্টি দেননি। তবে নিরাশও করেননি। দিয়েছেন মনের দূরদৃষ্টি। সেই মনের চোখ এতটাই প্রখর যে নিজ কর্ম দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন অভিশাপ নয় আশীর্বাদ হয়েই এসেছেন তিনি। তৈরি করলেন হায়দারাবাদের বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিষ্ঠাতা এবং একইসাথে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সাম্রাজ্য ছাড়িয়ে গেছে ৫০ কোটি কোটা। ইকো-ফ্রেন্ডলি পণ্য প্রস্তুতকরণ কাজে এই প্রতিষ্ঠানে তিনি সুযোগ দিচ্ছেন স্বল্প শিক্ষিত এবং শারীরিক ত্রুটি নিয়ে নিগৃহীত জীবনযাপন করা মানুষগুলোকে।তাদের ত্রুটিমুক্ত কাজ এবং একাগ্রতা থাকায় স্বল্প সময়ে আজ এই প্রতিষ্ঠান উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে ভারতে।
শ্রীকান্তের বাবা-মা’র বার্ষিক আয় সর্বসাকুল্যে ২০ হাজার টাকা। তার উপর শ্রীকান্তের কারণে কম সইতে হয়নি মানুষের কটুক্তি। সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে বড় করেছেন শ্রীকান্তকে। শ্রীকান্ত মনে করেন তার বাবা-মা তাকে বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়েছিল বলেই আজ তিনি এই জায়গায়।
সর্বহারাদের কেউ নেই
বড় হতে চাওয়ার ইচ্ছেগুলো সমাজ থেকেই মেরে ফেলা হয়। শ্রীকান্ত চেয়েছিলেন পড়ালেখা করবেন। তবে তার চারপাশের মানুষগুলোর নিদারুণ হেয়ালি-‘এই ছেলে কীভাবে পড়ালেখা করবে, যে কিনা চোখেই দেখে না !’ শ্রীকান্ত চেয়েছিলেন খেলাধুলা করবেন। সেখানে তাকে থাকতে হয়েছে ‘দুধ-ভাত’ হিসেবে। শারীরিক শিক্ষার ক্লাস গুলোতে তাকে সুযোগ দেওয়া হতো না। স্কুল ঘরে সবসময় তার জায়গা হতো পিছনের বেঞ্চ গুলোতে।বন্ধু বলতে কেউ ছিল না, বড়জোর তাদের বলা যায় সহপাঠী। তারাই তাকে তাচ্ছিল্য করে পিছনের দিকে পাঠাতো। এইসব মুখ বুঝে সহ্য করতে হতো তাকে। একটা মানুষ যখন এতটা অবহেলার স্বীকার হয় তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয় সেটা বোঝার মতো কেউ ছিলো না। ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’র মতো একাই লড়াই চালিয়ে গেলেন শ্রীকান্ত। শুধু ইচ্ছা-শক্তির জোরে এত বঞ্চনার মাঝেও তিনি হাল ছেড়ে দেয়নি।
এক পরিবর্তন-টার্নিং পয়েন্ট
শ্রীকান্ত চোখে দেখতে না পেলেও বাবার কষ্ট বুঝতে পারতেন। কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য বাবার সঙ্গে মাঠে চলে যেতেন। তবে তার বাবা শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। পাঁচ কিলোমিটার দূরের সেই স্কুলে শ্রীকান্ত যেত পায়ে হেটে। এত কিছুর পরও সেখানে তার অবহেলার স্বীকার হয়ে একা হয়ে পড়ার কষ্ট তার বাবা বুঝতে পারলেন। তাকে নিয়ে গেলেন হায়দারাবাদের একটা স্পেশাল স্কুলে যেখানে শ্রীকান্তের মতো আরো অনেকেই পড়ে। জীবন পাল্টাতে শুরু করে তার। দাবা-ক্রিকেটে প্রতিভার জানান দেন। পড়ালেখায় ও অসাধারণ ফলাফল অর্জন করতে থাকেন শ্রীকান্ত। এই স্কুলে থাকা অবস্থায়ই কাজ করার সুযোগ পান একটি প্রকল্পে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের সঙ্গে করা সেই প্রকল্পের নাম ছিলো লিড ইন্ডিয়া প্রজেক্ট।
তবুও কাটেনি বাধা
হায়দারাবাদের স্কুলে পড়ে নিজেকে শাণিত করেছেন শ্রীকান্ত। সবকিছুতেই তাঁর অর্জন চোখ কপালে ওঠার মতো। ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায়। স্বপ্ন দেখেছেন উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বার। এখানেও ‘না’ শুনতে হয়েছে আজন্ম বাধার সাঁতার কেটে কেটে বড় হওয়া শ্রীকান্তকে। বোর্ড থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ আর্টস নিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে শ্রীকান্ত। সংগ্রামের মাঝেই যার জীবন, সেই শ্রীকান্ত এবারও হাল ছাড়লেন না। মামলা ঠুকে দিলেন। অতঃপর ছ’মাস পর রায় দিলো কোর্ট শ্রীকান্তের পক্ষে। রায়ের প্রতি সুবিচার করলেন শ্রীকান্ত। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে উর্ত্তীন হলেন।
এরপর এলো আরো বড় বাধা। প্রকৌশল নিয়ে পড়ার স্বনামধন্য ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (আইআইটি) ভর্তি পরীক্ষার জন্য তাকে প্রবেশ পত্র দেওয়া হয়নি। তখন শ্রীকান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘আইআইটি আমাকে চায় না, ঠিক আছে, আমিও তাকে চাই না।’ আবেদন করলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটিতে। এমআইটির ইতিহাসে প্রথম অন্ধ শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি সেখানে গ্র্যাজুয়েশন করার সুযোগ পান নিজ যোগ্যতা বলে।
.
অতঃপর সাফল্যের ঝড়
সুযোগ পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট চাকরির। তবে শারীরিক-প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যে বৈষম্য সেটা দূর করতেই কিছু একটা করবেন বলে ঠিক করলেন। দেশে ফিরে হায়দারাবাদে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করালেন। শারীরিক ত্রুটি নিয়ে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের জন্য চাহিদা অনুযায়ী তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সহযোগিতা কার্যক্রম হাতে নিলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীদেরকে তিনি সেবা দিয়েছেন এ পর্যন্ত।
শারীরিক-প্রতিবন্ধীদের কাজ পেতে নানান সমস্যা পোহাতে হয়। এই বিষয়টি মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রি’। এখানে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কাজের সুযোগ দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব পণ্য প্রস্তুতের পাঁচটি ইউনিটে কাজ করছে ১৫০ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ। বার্ষিক আয় ৭০ মিলিয়ন রুপি ছাড়িয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানের। শ্রীকান্ত বলেন, তিনি শারীরিক ত্রুটিসম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারনা পরিবর্তন করতে চান। তাদের সক্ষমতার প্রমাণ তুলে ধরতে চান সবার কাছে।
এক সময় পুরো দুনিয়া তাকে বলেছিলো, ‘শ্রীকান্ত তুমি কিছু করতে পারবে না।’ আজ এই সাফল্যমুখর দিনে তিনি পিছনে ফিরে তাকান। সেইসব দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন। আজ তো তিনি বলতেই পারেন, ‘দেখো হে বিশ্ব! আমি যেকোনো কিছু করে দেখাতে পারি।’