আকাশে ওড়ার স্বপ্ন

আকাশে ওড়ার স্বপ্ন

  • ক্যারিয়ার ডেস্কঃ 

‘প্রথম যেদিন বিমান চালাই, মনে হচ্ছিল আমি ডানা পেয়ে গেছি।’ প্রশিক্ষণ ছাড়াই একলা বিমান চালানোর এই অভিজ্ঞতা যখন সামিয়া তাসনিম বলছিলেন, তখন তাঁর চোখ দুটি যেন সত্যি সত্যি পাখি হওয়ার প্রথম দিনটির স্মৃতি খেলা করছিল।

এরিরাং ফ্লাইং স্কুলের শিক্ষানবিশ বৈমানিক সামিয়ার পাশে বসে থাকা সদ্য কৈশোর পেরোনো বৈমানিক নাবিল কাসেম আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলতে থাকলেন, ‘বিমান থেকে সবকিছু ছোট মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো এক স্বপ্নের দেশে পৌঁছে গেছি।’


সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি বিমান চালনার দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষ করে এভিয়েশন লিমিটেড এক নৈশভোজের পর পরই কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের পাশে ছিল আকাশপথের আরেক সহযাত্রী বুশরা সিদ্দিক। এঁরা সবাই এরিরাং ফ্লাইং স্কুলের শিক্ষার্থী। দুই বছরের কঠোর পরিশ্রম শেষে তাঁরা এখন একলা বিমান চালাতে শিখেছেন। তাঁদের চোখেমুখে স্বপ্ন, একদিন তাঁরা বাণিজ্যিক বিমানের চালক হয়ে দেশ-বিদেশে উড়ে বেড়াবেন।

বুশরার প্রশিক্ষক সাজিদিনা সুলতানা কিছুটা কৌতুকের সুরে বলে উঠলেন, বুশরা যেদিন প্রথম বিমান চালায়, সেদিন তার হাত-পা কাঁপছিল। এখন ও যখন বিমান নিয়ে আকাশে ওড়ে, তখন মনে হয় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ কোনো বৈমানিক এটি চালাচ্ছে।

কথা বলে জানা গেল, ওই তিন শিক্ষানবিশ বৈমানিকের বয়সই ২০-এর নিচে। সবাই সদ্য উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বৈমানিক হওয়ার নেশায় এরিরাং ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হয়েছে। অবশ্য এখানে দুই বছরের প্রশিক্ষণ নেওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে ১৬ বছর হলেই চলে।

আকাশে ওড়ার কলাকৌশল শিক্ষার প্রশিক্ষক কাপ্টেন সাজ্জাদ হোসেন পাশে বসে তাঁদের প্রশিক্ষণার্থীদের স্বপ্ন আর বাস্তবের গল্প শুনে হাসছিলেন। তাঁদের সঙ্গে এই আলাপচারিতার আগে সন্ধ্যায় এরিরাং ফ্লাইং স্কুলের শিক্ষার্থীদের আকাশে বিমান চালিয়ে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছিল।

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চলের (কোরিয়ান ইপিজেড) একটি ভবনের ছাদে বসে যখন প্রশিক্ষণ বিমানগুলোকে উড়তে দেখা গেল, তখন সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল আকাশে কতগুলো পাখি আলো জ্বেলে উড়ছে। কোনোটা ডান আর কোনোটা বাঁদিকে এমনভাবে ওড়াউড়ি করছে, যেন চালকেরা বিমানগুলো নিয়ে খেলছেন।

প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ কিছুটা গর্বের সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘আমরা এখানে বিশ্বমানের পাইলট তৈরি করছি। দেশে তো বটেই, বিশ্বের যেকোনো এয়ারলাইনসে তারা চালক হিসেবে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করবে।

দিক্ষণ কোরিয়াভিত্তিক শিল্প গ্রুপ ইয়াংওয়ানের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এরিরাং এভিয়েশন লিমিটেড ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকারের সিভিল এভিয়েশন বিভাগ থেকে ২০১০ সালে ফ্লাইং স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমতি পায়। চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেডের প্রকৃতির লীলাভূমি ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার এক অপূর্ব সম্মিলনের মধ্যে এই হবু বৈমানিকদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছে।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সীমানার মধ্যেও রয়েছে হাতে-কলমে বিমান চালনা শেখার আরেকটি কেন্দ্র। সেখানে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে গ্লাস ককপিট এয়ারক্রাফট। তৃতীয় প্রজন্মের এই বিমানটি বাংলাদেশে একমাত্র এরিরাং ফ্লাইং স্কুলের কাছে রয়েছে৷ বৈমানিকদের দক্ষতা বাড়াতে স্থাপন করা হয়েছে একটি ডামি ককপিট রেড বার্ড এফএমএক্স ফ্লাইট সিমুলেটর। সেখানে বসে সত্যিকার বিমান চালানোর স্বাদ পাওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিজ্ঞানও পাওয়া যাবে।

প্রশিক্ষণ বিমানের সামনে এরিরাং ফ্লাইং স্কুলের শিক্ষার্থীরা৷ ছবি: ক্যাপ্টেন শিকদার মেজবাহউদ্দিন আহমেদবিমান ক্লাবটি থেকে সাতটি ব্যাচ ও একটি বিশেষ ব্যাচসহ মোট ১০৬ জন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ২২ জন ব্যক্তিগত বিমান ও ৪৪ জন বাণিজ্যিক বিমান চালানোর লাইসেন্স পেয়ে গেছেন। বাকিরাও লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন।

এরিরাং ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হতে হলে কী করতে হবে জানতে চাইলে উড্ডয়ন প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন শফিউদ্দিন কামাল জানান, ভর্তি হতে হলে সবার আগে বৈমানিক হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হবে। তারপর ১০০ নম্বরের ইংরেজি, অঙ্ক, সাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা দিতে হবে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মৌখিক ও কম্পিউটারে দক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই এখানে ভর্তি হওয়া যাবে।

বিমানের ককপিেট প্রশিক্ষক সাজিদিনা সুলতানা ও হবু বৈমানিক সামিয়া তাসনিম

কোথায় চাকরি

বৈমানিক হিসেবে দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করার পর প্রথমে বিমানের ফ্লাইট ক্রু হিসেবে চাকরি মেলে। এরপর ব্যক্তিগত বৈমানিক সনদ বা প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স দেওয়া হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যিক ও কার্গো বিমান চালনার সনদ মেলে।

দেশে বর্তমানে চারটি ফ্লাইং ক্লাব আছে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি, গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমি, ট্যাক অ্যারোনটিক্যাল একাডেমি ও এরিরাং ফ্লাইং স্কুল। এ ছাড়া রয়েছে আটটি হেলিকপ্টার৷ সেবাদানকারী কোম্পানি ১৭টি হেলিকপ্টার পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশ বিমান লিমিটেড, ইউনাইটেড এয়ার লিমিটেড, রিজেন্ট এয়ার, নোভো এয়ার বাণিজ্যিকভাবে চলাচল করছে। ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস ও এপিক এয়ারলাইনস লিমিটেড খুব দ্রুত তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া ইজি ফ্লাইট ও বিসমিল্লা নামের দুটি কোম্পািন অভ্যন্তরীণভাবে ও স্কাই ক্যাপিটাল আন্তর্জাতিকভাবে পণ্য পরিবহনের জন্য কার্গো বিমান পরিচালনা করছে।

এরিরাং ফ্লাইং স্কুল ছাড়াও ইয়াংওয়ান গ্রুপের মালিকানায় এরিরাং এভিয়েশন নামের একটি কোম্পানি রয়েছে। এই কোম্পানিটি বর্তমানে করপোরেট ফ্লাইট ও চার্টার ফ্লাইট চালু করেছে । আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তারা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চালু করতে যাচ্ছে।

সূত্রঃ প্রথম আলো

favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment