গৃহপরিচারিকার লেখক হয়ে ওঠা
- লিডারশিপ ডেস্ক
বাবার উদাসীনতা, অল্প বয়সে অতিরিক্ত কাজের চাপ, দীনহীন পরিবারে আরও সন্তানের জন্ম- সবকিছু মিলিয়ে বাবার প্রতি সন্তানদের বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। লৌইসা এবং তার বাকি বোনরা বুঝতে পারেন তারা আয় না করলে পরিবারের আর্থিক সমস্যা যেমন দূর হবে না, তেমনি শান্তির দেখাও আর মিলবে না।
নাম লৌইসা মে এলকোট। মানুষের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ দিয়ে শুরু যার ক্যারিয়ার। শেষটা রূপকথার গল্পের মতো। গৃহপরিচারিকা থেকে লৌইসা মে এলকোট হয়ে উঠলেন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক। একই সঙ্গে লড়েছেন মানবাধিকারের জন্যও।
১৮৩২ সাল। আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন লৌইসা মে এলকোট। বাবা ব্রোসন এলকোট ছিলেন পেশায় একজন শিক্ষক, সে সঙ্গে দার্শনিক। কিন্তু ব্রোসন যে ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন সেই সময় তার মতো চিন্তাধারার মানুষ তেমন ছিল না। যার ফলে তার মতবাদ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং কিছুটা উদাসী মনোভাবের কারণে ব্রোসন কোনো কাজে বেশিদিন টিকতে পারতেন না। এভাবে তো সংসার চালানো সম্ভব নয়। সংসারে কর্তা ব্যক্তিটির এমন উদাসীনতায় বিপদে পড়ে যায় এলকোট পরিবার।
বাধ্য হয়ে কাজে নেমে পড়েন লৌইসা। নেন গৃহপরিচারিকার কাজ। তখন তার পুতুল খেলার বয়স। সে বয়সেই দিব্যি জীবন-যুদ্ধে নেমে পড়তে হয় তাকে। কাজের পাশাপাশি বাসায় ফিরে বাবার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে থাকেন ছোট্ট লৌইসা। কিন্তু বাবা-মার দাম্পত্য কলহ সন্তানদের মনোজগতেও নানা রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বাবার উদাসীনতা, অল্প বয়সে অতিরিক্ত কাজের চাপ, দীনহীন পরিবারে আরও সন্তানের জন্মসব কিছু মিলিয়ে বাবার প্রতি সন্তানদের বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। লৌইসা এবং তার বাকি বোনরা বুঝতে পারেন তারা আয় না করলে পরিবারের আর্থিক সমস্যা যেমন দূর হবে না, তেমনি শান্তির দেখাও আর মিলবে না। অন্যদিকে এ আর্থিক অসঙ্গতির মধ্যেই স্কুল খুলে বসেন বাবা ব্রোসন এলকোট। কিন্তু যার মতের ওপর কারও বিশ্বাসই নেই, তার স্কুলে সন্তান পাঠাবেন, এমন কে আছে? একের পর এক স্কুল খুলে কিংবা উদাসী হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে যখন ব্রোসন সময় পার করছিলেন, তখন অমানবিক পরিশ্রম করে সংসারকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন এলকোট কন্যারা। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের হয়েও অশিক্ষিত ছিলেন না এলকোট কন্যারা। লৌইসার ক্ষেত্রে যেটি ছিল আরও বেশি সত্য। কৈশোরে পদার্পণের পর লৌইসা মানসিক চাপমুক্ত হতে শুরু করেন লেখালেখি। গৃহপরিচারিকার কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে একসময় কাজ শুরু করেন গৃহশিক্ষকের। তারপরও পরিবারের আর্থিক সমস্যার সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠতে পারছিলেন না লৌইসা। এবার শুরু করেন হাতে সেলাইয়ের কাজ। এরই মধ্যে ব্রোসন আরও কয়েকটি স্কুল খুলে আবার ব্যর্থ হয়ে পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েন। এদিকে দিনের পর দিন লিখে যাওয়া লেখাগুলো লৌইসাকে পরিণত লেখকে রূপান্তরিত করতে থাকে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই ‘ফ্লাওয়ার ফেবেলস’, যেটা কি-না সম্পূর্ণই লেখা হয়েছিল লৌইসার ছোটবেলার সঙ্গিনী এলেন ইমারসনের জন্য।
এরপর লেখালেখির নেশা পেয়ে বসে লৌইসা মে এলকোটকে। লেখালেখির পাশাপাশি ধীরে ধীরে নারী ভোটাধিকারের জন্য কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যেই আবার ছন্দপতন। ধীরে ধীরে লৌইসা যে চাকরি করতেন সেগুলো হারাতে শুরু করেন। পরিবারের বোঝা যার কাঁধে সে চাকরিহীন হয়ে গেল। আবারও একই দুরবস্থার মধ্যে পতিত হয় পরিবারটি। খুব হতাশ হয়ে পড়েন লৌইসা। একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেন। এরই মধ্যে গৃহযুদ্ধে পতিত হয় গোটা আমেরিকা। লৌইসা সেবিকা হিসেবে কাজ করার দীক্ষা নিতে শুরু করেন এবং গৃহযুদ্ধ চলাকালে সেবিকা হিসেবে কাজ করেন ইউনিয়ন হসপিটালে। কিন্তু হঠাৎ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পড়েন লৌইসা। সেবিকার কাজ ছেড়ে ফিরে আসেন ঘরে। খুব কাছ থেকে দেখা গৃহযুদ্ধ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের নানা অনিয়মকে ভিত্তি করে লেখেন অনবদ্য উপন্যাস ‘মুডস’। লৌইসা জানতেন তিনি কী হতে চান, কী করতে তার ভালো লাগে; কিন্তু পারিবারিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি তার সেই ভালো লাগা লেখালেখিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ‘মুডস’ প্রকাশিত হওয়ার পর শুধু নিজের ভালো লাগাকেই প্রাধান্য দিলেন। এর মাঝেই প্রকাশিত হলো তার আরেক বিখ্যাত উপন্যাস ‘লিটল ওমেন’। সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। কিন্তু লৌইসার সময় তখন ফুরিয়ে আসছিল। নানা অসুখে জর্জরিত হয়ে ওঠেন তিনি।
৬ মার্চ, ১৮৮৮ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে পৃথিবীকে বিদায় জানান লৌইসা। তার বাবা ব্রোসন এলকোটের মৃত্যুর ঠিক দু’দিন পর। জীবনের ঘানি টেনে ক্লান্ত লৌইসা নিজ অবস্থানে থেকে করে গেছেন সাহিত্যচর্চা। বলেছেন নারী অধিকারের কথা। কোনো কিছুর আশায় নয়, কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, কালের সাক্ষী হয়ে আজ থেকে শতবর্ষ আগে নতুনদের জন্য যে অমূল্য রতন রেখে গেছেন লৌইসা, এখনও তা অনেকের মনের খোরাক।