যে পথিক প্রশ্ন করতে জানে সে পথ হারায় না

যে পথিক প্রশ্ন করতে জানে সে পথ হারায় না

  • লিডারশিপ ডেস্ক

২০১১ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন লেমাহ বোয়ি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন এই লাইবেরিয়ান শান্তিকর্মী।

লিবিয়ায় যে জনপদে আমরা বেড়ে উঠেছি, সেটা দেখতে অনেকটা গ্রামের মতো। যদিও জায়গাটা শহরে। দাদি আমাদের দেখাশোনা করতেন। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মিশতেন। তাই ভিন্ন ভিন্ন পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, আচার-ব্যবহারসম্পন্ন মানুষের নিয়মিতই আমাদের বাসায় যাতায়াত ছিল। দাদি প্রায়ই রাস্তার ওপারে এক বৃদ্ধার কাছে বেড়াতে যেতেন। বৃদ্ধা ভুতুড়ে গাছগাছালিতে ঘেরা একটা জঙ্গলে থাকতেন, তাই লোকে তাঁর কাছে যেতে ভয় পেত।

একদিন এক বন্ধু বলল, বৃদ্ধা নাকি ডাইনি! সে ছোট শিশুদের ধরে খেয়ে ফেলে! কথা ছিল, আমরা দুই বোন এই ভয়ংকর তথ্যটা গোপন রাখব। কিন্তু আমরা দুজন ঠিক করলাম, ব্যাপারটা দাদিকে বলব। বললাম। দাদি ধৈর্য নিয়ে আমাদের সব কথা শুনলেন।

পরদিন সকালে তিনি বললেন, ‘চলো। আজ আমরা ওই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে যাব।’ আমরা দুই বোন মাটিতে পড়ে কাঁদতে শুরু করলাম। বললাম, কিছুতেই যাব না। দাদি কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি আমার সঙ্গে না আসো, জীবনের সবচেয়ে উঁচু স্বরের কান্নাটা আজই তোমাদের কাঁদতে হবে।’

দাদি জোর করে আমাদের সঙ্গে নিলেন। সেদিন থেকে শুরু করে বৃদ্ধার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমরা তাঁর বাসায় যাওয়া বন্ধ করিনি।

আজ আমার বক্তব্যের বিষয় ‘দ্য ওপেন মাইন্ড চ্যালেঞ্জ’। সাধারণত সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতা কারও মনে থাকে না। কারণ, বেশির ভাগের মনোযোগ থাকে খাবার আর অন্যান্য চমকপ্রদ আয়োজনের দিকে। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, আজ এই বিষয়টা মনে রেখো, ‘দ্য ওপেন মাইন্ড চ্যালেঞ্জ’।

আমরা একটা ঝঞ্ঝাটপূর্ণ পৃথিবীতে বাস করছি। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম—সব দিকে কেবল সমস্যা আর সমস্যা।

আফ্রিকা মহাদেশের ২৯টি দেশে যুদ্ধ চলছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ২৬৭টি বিদ্রোহী দল নানা দাবিতে লড়াই করছে।

ইউরোপের ১০টা দেশে ৮০টি বেসামরিক বাহিনী আছে।

এশিয়ার ১৬টি দেশে সক্রিয় আছে ১৬৪টি বিদ্রোহী-বেসামরিক দল।

এমন আরও বহু উদাহরণ আমি দিতে পারি। কারণ, এসব ভয়ংকর ঘটনাই আমাকে রাগিয়ে তোলে আর কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।

জানুয়ারি থেকে জুন—এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে ৬৭১টি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে।

ইরাকে আড়াই শ মানুষের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে এক দিনে।

এমন একটা পৃথিবীতে আমাদের বাস করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ‘পৃথিবীর আসলে হয়েছেটা কী?’ এর মূল কারণ আমার আর ‘আমার চেয়ে অন্য রকম’—এই দুইয়ের মাঝখানে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেওয়া। দেশে দেশে তো সীমানা আছেই। আমরা আমাদের সম্প্রদায়, স্কুল এমনকি দুঃখজনকভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও দেয়াল তুলে দিয়েছি।

পৃথিবীতে সব উল্টাপাল্টা ঘটছে। ভয় আর বিভাজনের রাজনীতি সব দখল করে নিয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা আমাদের সাধারণ মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি। উদ্বাস্তু অথবা অভিবাসীদের নাম শুনলেই আমরা ভীত হই। কোনো কিছু ভালোভাবে না জেনেই মানুষ একটা উপসংহারে পৌঁছে যায়, যেটা নেতিবাচক অনুভূতি ছড়ায়।

এখন আমাদের সময় সবকিছু ভালোভাবে জানার। স্রোতে গা ভাসিয়ো না। সত্যটা না জেনেই কাউকে তোমার প্রতিপক্ষ ভেবো না।

এখন আমাদের ‘ওপেন মাইন্ড চ্যালেঞ্জ’ নেওয়ার সময়। বিভাজন তৈরির বদলে আমাদের বরং ভয়ের সীমানা পেরোতে হবে। অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। লাইবেরিয়ায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘যে পথিক প্রশ্ন করতে জানে, সে কখনো পথ হারায় না।’

স্নাতক বন্ধুরা, মনের দরজা খুলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পৃথিবীকে শান্তির দিকে এগিয়ে নেওয়াই আজ তোমাদের দায়িত্ব। শ্রদ্ধেয় দালাই লামা বলেন, ‘শান্তি আমরা সবাই চাই। কিন্তু কীভাবে শান্তি মিলবে—ভেবে প্রায়ই দ্বিধান্বিত হই। পরস্পর বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের মধ্যেই আসলে শান্তি নিহিত।’

যখন ছোট ছিলাম, আমি আর আমার বোন রাস্তা পেরিয়ে সেই বৃদ্ধার কাছে যেতে ভয় পেতাম। কারণ, এমন একটা সমাজে আমরা বাস করতাম, যেটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেয়, আর না জেনেই অদ্ভুত সব গালগপ্প তৈরি করে। সত্যটা জানতে ঘরের আরাম ফেলে কষ্ট করে আমাদের রাস্তা পেরোতে হয়েছে। আমরা জেনেছি, সেই বৃদ্ধা তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে থাকেন। তিনি এতটাই অসুস্থ যে হাঁটতেও পারেন না। রাস্তা পেরিয়ে তবেই আমরা জেনেছি, কিছু ঠকবাজ প্রতারণা করে তাঁর সহায়-সম্পদ দখল করে নিয়েছে। জঙ্গলে থাকাটাই ছিল তাঁর প্রতিবাদ। আমরা জেনেছি, অতিথির জন্য তিনি পথ চেয়ে বসে থাকতেন। কেউ এলে তাঁর সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতেন। জানতেও চাইতেন না, ‘আপনি কে? কোথা থেকে এলেন?’

আমি আর আমার বোন যদি সেদিন রাস্তা না পেরোতাম, এগুলো আমাদের জানা হতো না। দাদি সেদিন আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা সেদিন আমরা পেয়েছি, আর তা হলো মনের দরজা খুলে দেওয়ার শিক্ষা।

তরুণেরা, মনের দরজা খুলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ এখন তোমাদের সামনে।

মার্টিন লুথার কিংয়ের একটা কথা দিয়ে শেষ করি, ‘একজন ভালো প্রতিবেশী সব সময় বাহ্যিক দোষত্রুটি ছাপিয়ে ভেতরের গুণটা দেখেন। আর এভাবেই তিনি তাঁর আশপাশের সবাইকে “মানুষ” হিসেবে মূল্যায়ন করেন, ভাই বা বোন ভাবতে শেখেন।’

তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

সূত্র: মোটো ডট টাইম ডট কম

Sharing is caring!

Leave a Comment