গাড়ির জাদুকর বাংলাদেশী লিপু
- লিডারশিপ ডেস্ক
‘আই অ্যাম দ্য কার ডিজাইনার, আই গ্রো আপ ইন বাংলাদেশ।’ জনপ্রিয় চ্যানেল হিস্টরিতে একটি গাড়ি বিষয়ক শো-এর ‘প্রমো’র শুরুটা এভাবেই। দেখতে দেখতে আপনার চোখ আটকাতেই পারে। নড়েচড়ে বসে আবার শোনার চেষ্টা করতেই পারেন। কিন্তু হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া। লিপু নামেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশে পরিচিতিটা খুব কম হলেও বিশ্বের কার প্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের ছেলে লিপু। হবেনই বা না কেন? পুরোনো গাড়ি ভেঙ্গে-চুড়ে, তার হাতের জাদুতে হয়ে ওঠে মনোহরি সব ডিজাইনের গাড়ি।
হিস্টোরি চ্যানেলে ‘লিপু অ্যান্ড পিটবুল’ নামের তার সিরিজ শো-টি জনপ্রিয় হয়েছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের গর্ব এই গাড়ির জাদুকরের সঙ্গে কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বণিক বার্তাকে জানান তার সফলতার পেছনের নানা গল্প।
লিপুর শুরুর ঘটনাটা পরে বলছি। তবে প্রচারটা পায় ২০০৬ সালে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ডিসকভারিতে দুই পর্বের অনুষ্ঠান দিয়ে। অনুষ্ঠানে দেখানো হয় লিপু আট সপ্তাহের মধ্যে দু’টি সাধারণ সিডান গাড়িকে স্পোর্টস কারে পরিণত করছেন। আর তাকে এ কাজে সাহায্য করেন ব্রিটিশ কার মেকানিক বার্নি ফাইনম্যান। ডিসকভারির ধরে দেয়া সময়ের এক সপ্তাহ আগেই গাড়ি দু’টি বানিয়ে ফেলেন লিপু। অনুষ্ঠানের নামও হয় ‘বাংলা ব্যাংগারস’।
দুই পর্বের অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হবার পর সেটার ধারাবাহিক অনুষ্ঠান হিসেবে শুরু হয় ‘চপশপ : লন্ডন গ্যারেজ’ নামে। মূলত এটা ছিল একটা রিয়ালিটি শো। এতে ভাঙা বা পুরনো কোনো গাড়িকে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী দামি কোনো গাড়িতে পরিণত করে দেয়া হতো। অনুষ্ঠানটি একসময় ইউরোপের অন্যতম জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
লিপুর গাড়ির ডিজাইনটা একেবারেই ইউনিক। প্রযুক্তির ধার ধারেন না তিনি। সম্পূর্ণ নিজের বিচার-বিবেচনার ওপর নির্ভর করে তিনি একটি গাড়ির নকশা করে ফেলেন। বিদেশের মিডিয়ায় এটা ‘বাংলা স্টাইল’ নামে খ্যাতিও পেয়েছে। এ বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনাও করেন তিনি।
এবার আসি শুরুর কথায়। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেয়া লিপুর শৈশব কেটেছে ঢাকায়। পড়েছেন ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে চলে যান সৌদি আরবে। সেখানে ১৬ বছর বয়সে লিপু তার জীবনের প্রথম মোটর শো দেখেন। শোতে ছিল বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের গাড়ি। তবে তাঁর চোখ টেনে নিয়েছিল স্পোর্টস কার, বিশেষ করে ‘ফেরারি’। কিন্তু এগুলোর দাম এত বেশি যে কেনার আশা করেননি লিপু। তাই বলে স্পোর্টস কারের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা বাদ দেননি। স্বপ্ন পূরণ করলেন ১৯৮৯ সালে। সাধারণ একটি সিডান কার ভেঙেচুরে গড়লেন ‘ল্যামবার্গিনি ক্রাউনটেশ’।
‘ল্যামবার্গিনি ক্রাউনটেশ’-এ থেমে থাকেননি লিপু। তত দিনে পরখ করা হয়ে গেছে নিজের সক্ষমতা। এবার ঠিক করলেন, ‘লিমুজিন’ বানাবেন। মাত্র ৪০ দিনে বানিয়েও ফেললেন একটি। ২৮০০ সিসির এই গাড়ি তৈরিতে তাকে সহায়তা করেছেন ছোট ভাই দীপু। কয়েকটি গাড়ি পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ২২ ফুট দৈর্ঘ্যের গাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। বিলাসবহুল লিমুজিন গাড়িতে সাধারণত যা থাকে, এতেও সেসব সংযোজন করা হয়। ছিল পানীয় রাখার কেবিনেট, টিভি, ইন্টারকম। যখন এটা ঢাকার রাস্তায় বের হতো, তখন হা করে তাকিয়ে থাকত সবাই। এতে ২ দশমিক ৮ লিটারের একটি ডিজেলচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানালেন লিপু।
লিমুজিনের পর এবার লিপুর ঝোঁক পড়ল তার পুরনো প্রেমের প্রতি। আর সেটা হলো সুপারকার ‘ফেরারি’। ২০০২ সালের শেষ দিকে লিপু ফেরারি তৈরি শুরু করেন। এসব কাজের জন্য লিপুর বিশেষ গ্যারেজটি ছিল নিজের জিগাতলার বাড়িতেই। সেখানে তার কাজে সাহায্য করত চারজন মেকানিক। ফেরারিটি বানাতে তিনি যে ধাতব শিট ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলো সাধারণত রিকশা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। গাড়ির বডি প্যানেলের নকশাটা ছিল সম্পূর্ণ তার করা। এতে সংযোজন করা এক জোড়া লাইট আর মনোগ্রামগুলোই শুধু আসল ফেরারি থেকে নেয়া। এ সময় বিবিসি তাকে নিয়ে একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রচার করে। এই রিপোর্টের সূত্র ধরে ফেরারি ওনার্স ক্লাব তাকে স্থান দেয় তাদের ওয়েবসাইটে। লিপুর বানানো ‘স্বাধীনতা এফ-৭১’ নামের গাড়িকে এই সাইটে ‘দ্য বাংলাদেশ ফেরারি’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
লিপু অটোমোবাইলে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস ইনস্টিটিউটে। সেখানকার পুঁথিগত বিদ্যায় বিরক্ত হয়ে পড়াশোনা শেষ না করেই চালু করেন নিজের একটি ওয়ার্কশপ। আসলে তিনি কাগজে-কলমের চেয়ে হাতে-কলমে শেখার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ছিলেন। ওয়ার্কশপটা চালালেন টানা তিন বছর। তারপর চলে এলেন বাংলাদেশে। দেশে তিনি লোকজনের পছন্দমাফিক গাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। আর সেটা তিনি করতেন জাপানি গাড়ি ডাইহাতসু আর টয়োটা গাড়ি ব্যবহার করে। ফ্রান্সের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘ইন্টারসেকশন’ ২০০৪ সালে লিপুকে নিয়ে একটি ফিচার করে, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দেয়।
২০০৬ সালে এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মোটর শোতে প্রদর্শিত হয় লিপুর বানানো স্পোর্টস কার ‘এম২৬’। ২২ বছরের পুরনো টয়োটা স্প্রিন্টারকে মডিফাই করে গাড়িটি বানানো হয়। পরের গাড়ি ‘দ্য পিস কার’ প্রদর্শিত হয় সে বছরেরই ৭ মে, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে। গাড়িটি এতটাই পরিবর্তন করা হয়েছিল যে ধরা যাচ্ছিল না এটা আসলে ছিল একটি ১৯৭৯ টয়োটা ক্রাউন। এরপরই ডিসকভারির প্রোগ্রাম। আর পেছনে তাকাননি তিনি।
২০০৬ সালের জুনে লিপুকে আমন্ত্রণ জানানো হয় যুক্তরাজ্যে। সেখানে তিনি আবাসিক শিল্পী হিসেবে গাড়ি রূপান্তরের একটি প্রকল্পে কাজ করেন। দুই মাস ধরে কাজ করে লিপু একটি ফোর্ড ক্যাপ্রিকে আরো স্টাইলিশ গাড়িতে পরিণত করেন। ‘কার’ নামের সেই গাড়ি বানানোর একটি প্রামাণ্যচিত্রও বানানো হয়। গাড়িটি পরে পূর্ব লন্ডনের ‘দ্য রিচ মিক্স সেন্টারে’ প্রদর্শিত হয়।
যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে ২০১১ সালের দিকে বানিয়ে ফেলেন এমন একটি গাড়ি। নিজের দাদার নামে গাড়িটির নাম রাখেন ‘সুরুজ’। গাড়িটি তিনি বানিয়েছে বাংলাদেশি মানুষের কথা চিন্তা করেই। গাড়িটি গ্যাস, তেল কিংবা বিদ্যুতেও চলবে। আর দাম পড়বে আড়াই লাখ টাকা মাত্র।
লিপু এখন নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটিতে থাকছেন। তার অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার লিপু এবং তার পরিবারকে সর্বোচ্চ মর্যাদার অভিবাসন সুবিধা দিয়েছে।