ডেবরাহ এফরয়মসনের গল্প
- লিডারশিপ ডেস্ক
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউ মেক্সিকোয় জন্ম ডেবরা এফরয়মসনের। বড় হয়ে ঔপন্যাসিক হবেন— এমন স্বপ্ন ছিল তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একদিন রিমোট হাতে টিভি চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে চোখে পড়ে ‘পিস ওয়ার্ক’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী দলের কার্যক্রম। পরে যুক্ত হন সংগঠনটির সঙ্গে। আমেরিকার এ বাসিন্দা এখন ঢাকাতে বসবাস করছেন
১৯৮৩ সালে ১৭ বছর বয়সে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা নিয়ে পড়তে শুরু করেন। শিক্ষকরা জানালেন তার উচ্চারণ খুবই খারাপ। বিষয় পরিবর্তন করে নিলেন ইংরেজি। একদিন টিভিতে আমেরিকান একটি স্বেচ্ছাসেবী দলের অনুষ্ঠান দেখছিলেন তিনি। সেখানে দেখলেন লিবিয়ায় আমেরিকান এক স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। এসব দেখে পিস ওয়ার্ক নামে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেন ডেবরা। এ কাজে খুব কষ্ট হলেও অনেক কিছু শিখবেন ধরে নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে সময় সেন্টার ফর সায়েন্স সংগঠনের হয়ে দুই বছর পুষ্টি নিয়ে কাজ করেন। পরের বছর নিউ মেক্সিকোতে রোড রুমার ফুড ব্যাংকে কাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানটি গরিব লোকদের খাবার দিত। পাশাপাশি বোস্টনে আরেকটি ফুড ব্যাংকেও কাজ করেন। অঞ্চলটি খুবই দরিদ্র ও অনুন্নত এলাকা। অল্প বয়সে দেখেছেন আমেরিকার দারিদ্র্য কী, কত বেশি? এবং তাদের সাড়াটা কেমন? বোস্টনে একটা শেল্টার হোমে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন তিনি।
১৯৮৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর পিস কোর প্রোগ্রামের মাধ্যমে মধ্য আমেরিকার গুয়াতেমালায় কাজ করার সুযোগ হয় তার। ডেবরাহ বলেন, ‘গুয়াতেমালার জনজীবন অনেকটা বাংলাদেশের মতো। এই ধরো, আমি কোনো দোকানে গেছি, বিক্রেতা বিদেশী দেখে গল্প করতে আগ্রহী হয়। ধীরে ধীরে অন্য মানুষ ভিড় করে।’
এখানে থাকার সময়ই স্প্যানিশ শেখেন ডেবরাহ, দুই বছরের বেশি সময় এখানে কেটেছে তার। একসময় বুঝলেন উপন্যাস লেখার জন্য যে ধৈর্য দরকার, সেটা তার নেই। এদিকে ভালো চাকরির জন্য প্রয়োজন মাস্টার্স ডিগ্রি। এক আত্মীয়ের পরামর্শে পাবলিক হেলথ নিয়ে হার্ভার্ডে মাস্টার্স করলেন। একদিন ক্যাম্পাসে স্প্যানিশ ভাষা ক্লাবের এক বন্ধু তাকে বলেন গ্রীষ্মের তিন মাস বন্ধে আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনে আবেদন করতে। পরবর্তীতে এ সংগঠনের হয়ে বলিভিয়া, কলম্বিয়া, একুয়েডরে পোলিও ও অন্যান্য রোগের ওপর জরিপের কাজ করার সুযোগ পান ডেবরাহ।
এখানে থেকে ফিরে আবার পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে যান। তখন ১৯৯৩ সাল। মাস্টার্স শেষে পরের বছর পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সংগঠনে সুযোগ পেয়ে চলে যান ভিয়েতনামে। এখান থেকে চাকরির শেষের দিকে ৯৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ অথবা শ্রীলংকা আসতে হবে বলে জানেন তিনি। আইসিডিডিআর’বিতে চাকরি করতেন চীনা অধ্যাপক লিংকন চেন। তিনি ডেবরাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ মানে অনেকগুলো সমস্যা, অনেক রোগ।’ এ কথা শুনে ডেবরার কৌতূহল হলো এ রকম দেশ কেমন হবে? ভাবলেন বাংলাদেশে যাই, কোনো একটা পরিবর্তন হবে।
বাংলাদেশে তখনই প্রথম আসা। এসে ঢাকায় একটি হোটেলে ছিলেন তিনি। একদিন ইস্টার্ন প্লাজায় একটি কাপড়ের দোকানে গিয়ে তার পরিচয় হয় সাইফুদ্দিন আহমেদ মাহবুবের সঙ্গে। ১৯৯৫ সালে ডেবরা যোগ দেন হেলথ ব্রিজ নামে একটি সংগঠনে। সে সুবাদে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসে কাজ করেন তিনি। শৈশবে ওই যে ঔপন্যাসিক হতে চেয়েছিলেন, লেখালেখির সে আগ্রহে ভাটা পড়েনি কখনো তার। তাই তো ভিয়েতনামে থাকাকালীন এইচআইভির ওপর বই লেখেন। বইটি জনপ্রিয় হয়। প্রথম সংস্করণে ভিয়েতনামের ভাষায় ৭৫ হাজার কপি ছাপানো হয়। তিনি মোট তিনটি বই লেখেন। স্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কাজ করেন তিনি।
১৯৯৭ সালে আবার বাংলাদেশে আসেন ডেবরা। উদ্দেশ্য এখানের স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করা। যোগাযোগ করেন পুরনো বন্ধু মাহবুবের সঙ্গে। ‘ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথমে তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। পরবর্তীতে শব্দদূষণ ও পলিথিন নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে সময় একটি সিগারেট কোম্পানি সমুদ্রপথে জাহাজ নিয়ে ৭০ দিনে ৭০ দেশে বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন চালাচ্ছিল। ক্যাম্পেইনের শেষ দেশ ছিল বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে বড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। ক্যাম্পেইন বন্ধে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন ডেবরা। যদিও শেষমেশ বাংলাদেশ সরকার এ অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। এ ঘটনাটি ডেবরার কাজে সাহস জোগায়। তামাকবিরোধী জোট গড়া শুরু করেন তিনি।
ঔপনাসিক হতে চেয়েছিল যে মেয়েটি, সেই ডেবরাহ এফরয়মসন নিজেকে নিয়োজিত করলেন জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক কর্মকাণ্ডে। ১৯৯৯ সালে সহকর্মী ও বন্ধু সাইফুদ্দিন আহমেদকে বিয়ে করেন তিনি। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মাদক-বিষয়ক প্রচারণা শুরু করেন। এভাবে কাজ করতে গিয়ে ডেবরাহ দেখলেন দারিদ্র্যই ধূমপানের অন্যতম উত্স। গরিব মানুষই বেশি ধূমপান করে। খাবার কেনার আগে তারা তামাক কেনে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ২০০১ সালে টোব্যাকো কন্ট্রোল জার্নালে এ বিষয়ের ওপর তার একটি লেখা ছাপা হয়। ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক ও দারিদ্র্য বিষয়ে প্রচারণা উপকরণ তৈরির জন্য আমন্ত্রণ জানায় তাকে।
ঢাকার রায়ের বাজারে ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের অফিস। বছরে বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশে কাটান তিনি। কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে ছুটে বেড়াতে হয় তাকে। ২০০৬ সালের কথা, অর্থনীতির ওপর একটি বই লিখতে শুরু করেন। অর্থনীতি নিয়ে না পড়লেও তামাকবিরোধী কাজ করতে গিয়ে দারিদ্র্যের কারণ তাকে বুঝতে হয়েছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কৌশলে চাপিয়ে দিচ্ছে দারিদ্র্য মানুষের ওপর। ভাবছিলেন কী করা যায়। ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকার ৫০টি দেশে গেছেন। সেখান থেকেও শিখছেন। ভাবলেন, মানুষকে জানানো দরকার তার অভিজ্ঞতা। বই লিখতে বসলেন। লিখতে তার সময় লেগেছে আট বছর। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘বিয়ন্ড অ্যাপলজিস’। এ বইয়ের ওপর কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে।