মায়ের হাসিই মুশফিকের প্রেরণা
- লিডারশিপ ডেস্ক
মা পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন এবং ভালোবাসার জায়গা। আর যারা মায়ের অনুপ্রেরণায় বড় হয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের টেস্ট দলের অধিনায়ক এবং মি. ডিপেন্ডেবল খ্যাত ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম তাদের একজন। কারণ সবার মায়ের চেয়ে তার মা একটু আলাদা। তাই সবার চেয়ে মায়ের প্রতি ভালোবাসা তার একটু বেশিই।
মায়ের প্রতি ভালোবাসা এবং ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিমের সাফল্য নিয়ে বিভিন্ন সময় দেয়া সাক্ষাৎকার এবং খবরের অংশ থেকে সংগৃহীত- বাড়ি থেকে বেরেনোর সময় মা তাকে কোনও দিন বলতে পারেননি, ‘জিতে ফিরিস’ বা বাড়িতে ফিরে কোনও দিন শোনা হয়নি, ‘ভালো খেলেছিস বাবা’ বা ‘আজ জিতিসনি, কাল ঠিক জিতবি’৷
প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আছেন নিয়মিত। আর বর্তমান সময়ে দেশের ক্রিকেট তারকাদের অন্যতম মুশফিক। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দিয়েছেন অনেক কিছুই তবে এসবের কোনো কিছুই প্রাণ খুলে মায়ের সাথে বলা হয়নি তার। অথচ মাকে মনে প্রাণে ভালোবাসেন তিনি। দেশে বিদেশে যেখানেই যান তার ব্যাগে রাখেন মায়ের ছবি। মা ও ছেলের মধ্যে ভাষার সেতুটা যে কোনও দিনই ছিল না৷ মুশফিকুর রহিমের মা রহিমা খাতুন চাইলেও কিছু বলতে পারেন না৷ ইচ্ছে হলেও শুনতে পারেন না! কারণ তিনি বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধি।
মায়ের এই নীরবতাই বাংলাদেশের অন্যতম সফল এ ক্রিকেটারের চলার পথের আলো৷ বিশ্বের যেখানেই যান, মুশফিকের ব্যাগে থাকা মায়ের ছবি৷ কোনও কথা হয় না৷ মনের ভাষাতেই হয়ে যায় মা-ছেলের সব কথা৷ গত বছর ভারতের বিপক্ষে ড্র করে ফতুল্লার মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুশফিকের গলা বুজে আসে আবেগে, ‘মা তো শুধু মা-ই হয়৷ সে কেমন, সেটা কোনও ব্যাপারই নয়৷ মাকে ভালোবাসার জন্য ভাষার প্রয়োজন হয় না৷’ সেদিন মায়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে মুশফিক জানাচ্ছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার মা অন্যদের থেকে একটু আলাদা৷ তাই বোধহয় আমিও সবার থেকে একটু অন্য রকম৷’
সবার চেয়ে মুশফিক একটু আলাদা বৈ কি। শান্ত, ভদ্র৷ পড়াশুনোয় রীতিমতো ভালো৷ ইতিহাসে মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস৷ কোনও পরীক্ষাতেই ফার্স্ট ডিভিশন ছাড়া সেকেন্ড ডিভিশন পাননি৷ সেই সঙ্গে চলেছে চুটিয়ে ক্রিকেট৷ আর ক্রিকেটে তার সফলতা কোনো লুকোচুরির বিষয় নয়।
সাকিব-তামিমদের মত মুশফিকও বাংলাদেশ সরকারের ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ফসল৷ ঢাকা থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে বগুড়ায় গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়কের৷ মুশফিকের বিষয়ে তার বাবা মাহবুব হামিদ কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাকে এক শিক্ষিকা বলেছিলেন, ছেলে এত ভালো পড়াশুনোয়, ওকে খেলাচ্ছেন কেন?’ বাবা অবশ্য বাধা দেননি৷ ক্রিকেট আর পড়াশুনো সমানে চালিয়ে গিয়েছেন৷ কী ভাবে সম্ভব? মুশফিকের বাবার থেকেই জানা গেল, জুনিয়র টিমে খেলার সময় থেকেই দুটো ব্যাগ নিয়ে যেত ছেলে৷ একটাও থাকত ক্রিকেট কিটস, অন্যটায় পড়ার বই-খাতা৷
মাহবুব হামিদের কথায়, ”ও যখন এসএসসিতে গোল্ডেন পেয়ে বাড়ি এলো, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম৷ বলেছিলাম, ‘কী করে এটা করলি?’ ও হেসে বলল, তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি!” নিজের জীবন সংগ্রামের কথা নিজে মুখে বলার বান্দা নন মুশফিক৷ লাজুক হাসিতে ছোট্ট সংযোজন, ”লড়াই তো সবাইকেই করতে হয়৷ আমিও করেছি৷ করিও৷ এতে নতুনত্ব কী আছে?” মায়ের নীরবতার মতো নীরবে নিজের কাজ করে যাওয়াই মুশফিকের জীবন দর্শন৷ ছোটবেলা থেকেই নিজের কাজ নিজে করতে ভালোবাসেন৷ যাকে বলে টিপটপ থাকা৷ বাড়ি তো বটেই, টিম হোটেলে যে ঘরে থাকেন, সেটাও নিজে হাতে পরিপাটি করে গুছিয়ে না রাখলে চলবে না, মায়ের আদরের মিতুর৷
চার ভাই, এক বোনের মধ্যে চতুর্থ মুশফিক৷ দেশের অধিনায়ক হিসেবে সফল৷ বাইশ গজে সাফল্যের জন্য মুশফিকের একটাই দর্শন৷ প্র্যাক্টিস৷ তার বাবার কথায়, ‘প্র্যাক্টিসই তো মুশফিকের সব৷ ছোটবেলায় ওকে কোচরা দু’ঘণ্টা প্র্যাক্টিস করতে বললে, ও করত চার ঘণ্টা৷’ গোটা টিম চলার অভ্যেসটা গড়ে উঠেছিল ছোটবেলায় বাড়িতে৷ যৌথ পরিবারে থাকার সৌজন্যে৷ ঢাকার উত্তরায় এখনও মাহবুব হামিদের পরিবার চার তলা বাড়িতে এক সঙ্গে থাকেন৷
গত মা দিবসে এক আবগঘন পোস্ট দিয়েছিলেন মুশফিক। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ”মানুষ বলে প্রথম দেখায় নাকি ভালোবাসা হয়না, কিন্তু পৃথিবীতে এসে তোমাকে প্রথমবার দেখেই আমি ভালোবাসতে শিখে ফেলেছি। আমি শিখেছি, মাকে ভালোবাসতে মুখের ভাষা লাগে না, মুখের একটি হাঁসি হাজার বাক্য বলে দেয়।তোমার এই মুখের হাঁসিই আমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা, মা!”
গত বছরের নভেম্বরে শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নিজের চতুর্থ সেঞ্চুরিটি মুশফিক উদযাপন করেছিলেন একেবারের ভিন্নভাবে। বলটিকে লংঅনের দিকে পাঠিয়েই দু’হাত ছড়িয়ে পাখির মতো ওড়ার ভঙ্গিতে ছুটেছিলেন সেঞ্চুরি স্পর্শ করার রানটির জন্য। আর নন স্ট্রাইক প্রান্তে পৌঁছে গর্জনে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন পুরো মাঠ। দলের বিপদে সেঞ্চুরি করলে একটু বেশিই ভালো লাগে। লাগাটা স্বাভাবিকও। তবে ঐ সেঞ্চুরিটি যে মুশফিকের জন্য আরও একটি কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শেরেবাংলার গ্যালারিতে এদিন হাজির ছিলেন তার মা এবং মায়ের সামনে ছেলের প্রথম সেঞ্চুরি। এর চেয়ে বড় আনন্দের উপলক্ষ আর কী হতে পারে!
আর সেদিন দুহাত তুলে মনের আনন্দে হাত তালি আর হাসি ভরা মুখে উদযাপন করেছিলেন ছেলের সাফল্য। নিজে যেটা করতে চান সেটাই করে ছাড়েন মুশফিক। এ দিক থেকে তিনি নিজেকে কিছুটা জেদি বলেও পরিচয় দেন। অনেকদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে জেদ নিয়ে মুশফিক জানিয়েছিলেন, ‘আমার স্বভাবের পুরোটাই মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আমার মা সাধারণ মায়েদের মতো না। তার শোনা বা কথা বলায় একটু সমস্যা আছে। কিন্তু যেটি করবেন বলে ঠিক করেন, ঠিকই করে ছাড়েন। আমিও তাই।’ এমন রত্নগর্ভা মা ভালো থাকুন আর ভালো থাকুন তার এবং ১৬ কোটি মানুষের গর্ব মুশফিকুর রহিম।