সর্বকালের সেরা ১০ ধনীর গল্প
- লিডারশিপ ডেস্ক
কার বেশি অর্থ-বিত্ত? জন ডি রকফেলার নাকি চেঙ্গিস খানের? প্রশ্নটা খুব সহজ হলেও উত্তরটা কিন্তু ভীষণ কঠিন। কারণ বিশ্বের ইতিহাসের শুরু থেকে এদের সময়কাল ছিল একেক সময়। ছিল ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র।
বিভিন্ন সময়ের অর্থনীতিবিদ ও ঐতিহাসিকদের নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১০ জন সেরা ধনী ব্যক্তির একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। টাইম ডটকম তাদের প্রতিবেদনে বলছে, যদিও এভাবে ইতিহাসের সেরা ধনীদের তালিকা তৈরি করাটা বেশ বিতর্কিত ব্যাপার তবু তাঁদের সম্পদের পরিসংখ্যানের হিসাবে এই তালিকা করা হয়েছে।
দেখে নিন পৃথিবীর ইতিহাসের ধনী ব্যক্তিদের তালিকা। তালিকার একেবারে শেষে রয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটির নাম।
১০. চেঙ্গিস খান (১১৬২-১১২৭)
দেশ : মঙ্গোলিয়ান সাম্রাজ্য, প্রচুর ভূমির মালিক ছিলেন তিনি।
চেঙ্গিস খান নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা বা সফল সেনাপ্রধান হিসেবে বিবেচিত হবেন। চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত এলাকা ছিল তৎকালীন মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সীমানার মধ্যে। আর এই সাম্রাজ্যের প্রধান হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বিরাট এলাকার অধিকারী ছিলেন তিনি। এত বিরাট সম্পদের অধিকারী ও ক্ষমতা থাকার পরও গবেষকরা বলেন, তিনি কখনোই তাঁর সম্পদ গোপন করতেন না।
কুইন কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক মরিস রোসাবি বলেন, চেঙ্গিস খানের সাফল্যের একটা বড় কারণ ছিল যে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ থেকে অর্জিত ধন সম্পদ নিজের সৈন্য সামন্তের মধ্যে ভাগ করে দিতেন।
চেঙ্গিস খানকে নিয়ে লেখা বই ‘চেঙ্গিস খান অ্যান্ড দ্য মেকিং অব দ্য মডার্ন ওয়াল্ড’-এর লেখক জ্যাক ওয়েদারফোর্ড বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, আধুনিক যুগের আগে যে সেনা ব্যবস্থা ছিল সেখানে দেখা যেত যুদ্ধ শেষে অধিকৃত সম্পদ সৈন্যরা নিজেরাই দখলে নিয়ে নিত। তবে মঙ্গোলীয়ান সাম্রাজ্যে এ ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে কোনো একটি যুদ্ধের পর অর্জিত বিভিন্ন সম্পদ রাষ্ট্রের নিযুক্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হতো। তারপর সৈন্য ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে এই সম্পদ বিলি-বণ্টন করা হতো।
চেঙ্গিস খানের নিজের ভাগেও বণ্টন করা সম্পদ জুটত। তবে এই সম্পদের মাধ্যমে তিনি বড়লোক হয়েছেন- এটা বলা যাবে না। চেঙ্গিস খান নিজের বা তাঁর পরিবারের জন্য কোনো জায়গা, প্রার্থনালয় বা কোনো বাড়িও তৈরি করেননি। যেমন সাধারণভাবে তিনি জন্মেছিলেন তেমন সাধারণ ভাবেই মৃত্যু হয় তাঁর। অন্য যেকোনো সাধারণ নাগরিকের মতোই বিশেষ ধরনের পশমি কাপড়ে মুড়িয়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
৯. বিল গেটস (১৯৫৫-বর্তমান)
দেশ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সম্পদের পরিমাণ ৭৮.৯ বিলিয়ন
বিল গেটস হলেন জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী। তাঁর সম্পদের পরিমাণ অনুমান করাটা তুলনামূলক সহজ। এ বছর ফোর্বস ম্যাগাজিন মাইক্রোসফটের এই প্রতিষ্ঠাতার মোট সম্পদের পরিমাণ নিরুপণ করেছে ৭৮.৯ বিলিয়ন। এই সম্পদ বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী আমানিকো অরতেগার চাইতেও আট বিলিয়ন বেশি।
৮. অ্যালান রুফুস (১০৪০-১০৯৩)
দেশ : যুক্তরাজ্য, সম্পদের পরিমাণ : ১৯৪ বিলিয়ন
যুক্তরাজ্যের প্রথম নর্মান রাজা ইউলিয়ামের ভাইয়ের ছেলে ছিলেন অ্যালান রুফুস। নর্মান শাসনামলে তিনি তাঁর চাচার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার পাউন্ড।
রিচেস্ট অব দ্য রিচ বইয়ের লেখকদ্বয় ফিলিপ বেরেসফোর্ড ও বিল রুবিনস্টেইনের মতে, এই পরিমাণ সম্পদ গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সাত শতাংশ। সেই সময়ের ১১ হাজার পাউন্ডকে ডলারে রুপান্তর করলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯৪ বিলিয়ন।
৭. জন ডি রকফেলার (১৮৩৯-১৯৩৭)
দেশ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মোট সম্পদের পরিমাণ : ৩৪১ বিলিয়ন
১৮৬৩ সালে পেট্রলিয়াম খাতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন জন রকফেলার। ১৮৮০ সালে তার স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ শতাংশ তেল উৎপাদন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯১৮ সালে রকফেলারের জমা দেওয়া আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী তাঁর জমা থাকা সম্পদের পরিমাণ ১.৫ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া সব মিলে সেই সময় তাঁর যে সম্পদ ছিল তা ওই বছরের যুক্তরাষ্ট্রের আয়ের দুই শতাংশ। ২০১৪ সালে যদি ওই সম্পদের হিসাব করা হয় তবে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৪১ বিলিয়ন ডলার।
৬. অ্যান্ড্রু কার্নেগি (১৮৩৫-১৯১৯)
দেশ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মোট সম্পদের পরিমাণ : ৩৭২ বিলিয়ন
সম্ভবত অ্যান্ডু কার্নেগি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধনী। ১৯০১ সালে জেপি মর্গানের কাছ থেকে ইউএস স্টিল কোম্পানিটি ৪৮০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নেন স্কটল্যান্ডের অভিবাসী ব্যবসায়ী কার্নেগি। যা ছিল সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপির ২.১ শতাংশেরও বেশি। এখনকার সময়ে কার্নেগির সম্পদকে রূপান্তর করলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭২ বিলিয়ন ডলার।
৫. জোসেফ স্টালিন (১৮৭৮-১৯৫৩)
দেশ : সোভিয়েত ইউনিয়ন
জোসেফ স্টালিনের এই পরিমাণ সম্পদ ছিল যা দিয়ে তিনি বৈশ্বিক জিডিপির ৯.৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আধুনিক অর্থনীতির ইতিহাসে স্টালিন একেবারেই ব্যতিক্রম এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন এমন একজন স্বৈরশাসক যার ছিল প্রবল ক্ষমতা। সেইসাথে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলকেও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। অবশ্য স্টালিনের সম্পদ আর গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পদকে দৃশ্যত আলাদা করা সম্ভব নয়।
একটি হিসেবে দেখা যায়, স্টালিনের মৃত্যুর তিন বছর আগে ১৯৫০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বৈশ্বিক অর্থনীতির ৯.৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। ২০১৪ সালের হিসাবে এই সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। যদিও এসব অর্থ সরাসরি স্টালিনের ছিল না তবে যেকোনো সময় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থ ব্যবহার করতে পারতেন। তাঁর ছিল সর্বময় ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতাবলে তিনি যা ইচ্ছা তাই পেতে পারতেন।
বার্মিংহামের আলাবামা ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক জর্জ ও লিবার বলেন, কোনো রকম চেক বা নগদ অর্থ ছাড়াই স্টালিন এই পৃথিবীর ছয় ভাগের একভাগ ভূমি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি পুরো দেশের সব সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতেন।
৪. সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫)
দেশ : ভারত
ভারতবর্ষের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান। সম্রাট আকবর যে পরিমাণ সাম্রোজ্যের শাসক ছিলেন তা গোটা বিশ্বের মোট জিডিপির ২৫ শতাংশ।
পুরো বিশ্বের অর্থনীতির চার ভাগের এক ভাগই ছিল সম্রাট আকবরের অধীনস্ত। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসনের মতে আকবরের সময়ে ভারতের জিডিপির সাথে এলিজাবেথের সময়ের ইংল্যান্ডের জিডিপির তুলনা করা চলে।
৩. সম্রাট শেনজং (১০৪৮-১০৮৫)
দেশ : চীন
সম্রাট শেনজংয়ের রাজত্ব ছিল চীনে। তাঁর শাসনামলে চীনের জিডিপির হার ছিল বৈশ্বির মোট জিডিপির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। চীনের অর্থনীতি বিষয়ের ইতিহাসবিদ প্রফেসর রোনাল্ড এ এডওয়ার্ড বলেন, শেনজংয়ের সাম্রাজ্য ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির সাম্রাজ্য। সেই সময় বিশ্ব অর্থনীতির চূড়ায় ছিল চীন। ইউরোপে শুরু হওয়ার শতবর্ষ আগেই শেনজংয়ের সাম্রাজ্যে কর সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু ছিল।
২. অগাস্ট সিজার (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩-খ্রিস্টাব্দ )
দেশ : রোম, মোট সম্পদের পরিমাণ : ৪.৬ ট্রিলিয়ন
বিশ্বের মোট অর্থনীতির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের দায়িত্বে ছিলেন অগাস্ট সিজার। ইতিহাসবিদ ইয়ান মরিসের মতে, তাঁর সাম্রাজ্যের মোট সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগের সমান সম্পদ ছিল সিজারের। ২০১৪ সালের হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪.৬ ট্রিলিয়ন। ব্যক্তিগতভাবে অগাস্ট পুরো মিসর জয় করেছিলেন।
১. মানসা মুসা (১২৮০-১৩৩৭)
দেশ : মালি
মানসা মুসা ছিলেন মালির টিমবাকুটুর রাজা। বলা হয়ে থাকে তাঁর কত সম্পদ ছিল তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। মুসাকে ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বলা হয়। ইতিহাসবিদ রিচার্ড স্মিথের মতে, মুসার পূর্ব আফ্রিকার সাম্রাজ্যের ভেতরে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোনার খনি। সেই সময় সোনা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দামি বস্তু।
মুসা কি পরিমাণ ধনী ছিলেন তা বোঝাতে কোনো সঠিক সংখ্যা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। সমসাময়িক কিছু সূত্র বলছে, সম্রাট মুসা এত বেশি ধনী ছিলেন যা বর্ণনা করা পুরোপুরি অসম্ভব।
মুসার সৈন্য সামন্ত সম্পর্কে কথিত আছে যে, তাঁর সেনাবাহিনীতে দুই লাখ সদস্য ছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন ৪০ হাজার তীরন্দাজ। বর্তমান সময়ের অনেক আধুনিক বাহিনীতেও এত সংখ্যক সদস্য নেই। এ ছাড়া মুসার জীবন যাপন এত বিলাসী ছিল যে এজন্য মিসরে একবার মুদ্রা সংকটও দেখা দিয়েছিল। মুসার কত সম্পদ ছিল সেটা বর্ণনা করা একজন সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর বলে মন্তব্য করেছেন ইতিহাসবিদ রুডলফ ওয়ার।
মুসার একটি প্রতিকৃতির বর্ণনা দিয়ে রুডলফ বলেন, ‘যে কারো দেখা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন সম্রাট মুসা। প্রতিকৃতিটিতে দেখা যায়, সোনার সিংহাসনে হাতে সোনার রাজদণ্ড নিয়ে বসে আছেন মুসা। এ সময় তার হাতে রয়েছে একটি সোনার পাত্র এবং মাথায় সোনার মুকুট।’