আলো দেখাচ্ছেন ভিনদেশি নারী
- লিডারশিপ ডেস্ক
সমাজে নানাভাবে অবহেলিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েদের দুঃখের কাহিনী দু’একটা অনেকেরই জানা। তার পরও কিছু কথা ব্যক্ত করতেই হয়। রিকশাচালক বাবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে পেয়ে কষ্টের বদলে খুশি হয়েছিলেন। মেয়ে যত বড় হয় বাবার স্বপ্ন আরও বড় হয়। মেয়ের ভিক্ষাবৃত্তি থেকে আসবে অনেক টাকা। এরই মধ্যে বাদ সাধেন মা। তিনি মেয়েটিকে ভর্তি করে দেন এ স্কুলে। এই নিয়ে ঝগড়া করে সংসার ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করে নতুন সংসার পাতেন বাবা। দুঃখিনী সে মা অভাবের মধ্যেও মেয়ের পড়াশোনার গতি ঠিক রেখেছেন।
শিক্ষাকে আলো হিসেবে চিহ্নিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামে থাকে আলোর চিহ্ন। শিক্ষার সঙ্গে আলো সমানভাবে চললেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েরা শিক্ষার জন্য আলোর অপেক্ষায় বসে থাকে না। ব্রেইল বই তারা পড়তে পারে আলো ছাড়াই। আলো ছাড়াই আলোকিত তারা। শহর ও শহরের বাইরের জেলার মেয়েরা একসঙ্গে থেকে এখানে পড়াশোনা করছে স্বাচ্ছন্দ্যে।
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্করের কাছে সেনপাড়া পর্বতায় এ স্কুলের রয়েছে প্রশস্ত মাঠ। চারদিক ফুলের বাগান আর সবুজে ছাওয়া। স্কুল ভবন একতলা হলেও আবাসিক ভবন দোতলা। বিশাল খাবার ঘর। সবাই মিলে একসঙ্গে খাবার গ্রহণ করে। এ প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মমতা বৈরাগী জানালেন, ‘কোনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে ডাক্তারি পরীক্ষায় যদি ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ার অনুমতি পায় তবেই সে এখানে ভর্তি হতে পারবে। শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার খরচ মিশনারিজই চালাত। এখন তারা ফান্ড দেয় না। শুধু পড়াশোনা ও ব্যবস্থাপনাই দেখছে তারা। সহায়তা বন্ধ হওয়ার কারণে ২০১০ সাল থেকে পড়া ও থাকা-খাওয়ার ফি ধার্য করা হয়েছে। এখানে একজন শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনা বাবদ মাসিক খরচ দুই হাজার ৫শ’ থেকে তিন হাজার টাকা। অনাবাসিক শিক্ষার্থীও আছে ২৫ জন। তাদের মাসিক খরচ সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। তারপরও দেখা যায় বছরে তিন মাসের শিক্ষকদের বেতন ঘাটতি থেকে যায়। শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ধার্য করায় অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেছে। তবে আমি দেখছি এটা শিক্ষার্থীর জন্য মঙ্গলই হয়েছে। আগে একজন শিক্ষার্থী এখানে দিয়ে অভিভাবকরা আর খবর নিতেন না। বছরের পর বছর ফেল করলেও এ থেকে উদ্ধারে কেউ কথা বলতেন না। এখন যেহেতু প্রতি মাসে ফি দিচ্ছেন, তাই অভিভাবকরা এসে দেখছেন তার মেয়ের লেখাপড়া, বইপত্রের কী অবস্থা। জাপানের জাইকার সহায়তায় এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সে হিসেবে জাপানের এক প্রশিক্ষক এখানে কাজ করেছেন কিছুদিন। জঙ্গি পরিস্থিতির কারণে সে প্রশিক্ষক জাপান চলে যাওয়ায় এ প্রকল্প আপাতত বন্ধ।’
তিনি আরও জানালেন, এ স্কুলটি সরকারি সহায়তা পায় না। আমার আগে যে অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি অনেক বেশি দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেও কোনো সহায়তার ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাই আমি এ পথে পা বাড়াইনি। বইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে আগেই চাহিদাপত্র পাঠালেও এ বছর বই পাওয়া যায়নি এক কপিও। নতুন বইয়ের জন্য যোগাযোগ করার পর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বই নিয়ে গেছে অন্য প্রতিষ্ঠান। তার পরও আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিক্ষার্থীদের ফি এবং কিছু সহায়তায় ধীর গতিতে চলছে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি। সেনপাড়া পর্বতার বিলাসবহুল আবাসিক এলাকায় বড় জায়গা নিয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েরা পড়াশোনা করবে_ এটা কম পাওয়া নয়। এখন শুধু পড়াশোনার পথটুকু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেড বোর্ডের আওতায় ন্যাশনাল কারিকুলামে পরিচালিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সহায়তা প্রয়োজন। সহায়তা করতে পারেন যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তবে সেটা করতে হবে প্রতিষ্ঠানের নিয়মের মধ্যে থেকে। এসব মেয়ের মধ্য থেকেই হয়তো আগামী দিনের দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসক বেরিয়ে আসবে। যারা নেতৃত্ব দেবে প্রিয় বাংলাদেশকে। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মমতা বৈরাগীর মতো স্বপ্নটা দেখতে পারেন যে কেউ।