বিশ্বাস রাখতে হবে আমিই পারব
একুশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব মানবসভ্যতার গতি ও প্রকৃতি খুব দ্রুত বদলে দিচ্ছে৷ তাই দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনমান৷ উন্নত মানের জীবন ও টেকসই বিশ্ব গড়তে তথ্যপ্রযুক্তির সেবা আবশ্যক। সারা বিশ্বে এখন তথ্যপ্রযুক্তির যে বিশাল বাজার আছে তা আমাদের অনেকেরই জানা। বিশ্বায়নের প্রভাব এবং বৈশ্বিক মন্দার কারণে এখন খরচ কমানো উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ কোম্পানির একধরনের নীতিতে পরিণত হয়েছে। আর এর ফলে বড় একটি সুযোগ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তৈরি হয়েছে।
আমাদের দেশের ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী যুবক, আর আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই তরুণ প্রজন্মই তথ্যপ্রযুক্তিতে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। বর্তমানে নাসা, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকসহ আরও বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা। আমাদের দেশের অনেক প্রতিভাবান তরুণ প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন ভালো সুযোগ পেয়ে। তাঁদের পাঠানো অর্থ আমাদের অর্থনীতিকে চাঙা করছে। কিন্তু আমি মনে করি তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের নতুন দুয়ার খুলতে এক বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী মনে করেন, প্রকৌশলী হওয়া ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করা সম্ভব না, এ ব্যাপারটা একদমই ভুল। আমার তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করার গল্পটা শুনলেই আপনারা তা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন।
কম্পিউটার নামক যন্ত্রের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৯ সালে। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আমার ছোট মামা সেই সময় বিশাল বড় এক ব্যাংকঋণ নিয়ে আমাদের জন্য কিনে আনলেন একটি কম্পিউটার। প্রথম দিকে আমার কাছে কম্পিউটার মানে গেম খেলার একটি যন্ত্র। একদিন হঠাৎ ঘটল এক বিপত্তি। কম্পিউটার আর চালু হচ্ছিল না এবং সবার অভিযোগের তির আমার দিকে। সবার এক কথা, গেম খেলতে খেলতে কম্পিউটার নষ্ট হয়েছে। দায়টা নিজের কাঁধেই নিলাম এবং আমি ঠিক করে আনব বলে কথা দিলাম। কথা দিয়েও সমস্যায় পড়লাম কীভাবে ঠিক করাব, কার কাছে নেব, তখন কম্পিউটার মেরামত অনেক ব্যয়বহুল ছিল। এলাকার এক বড় ভাই পেলাম, যিনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন; উনি দেখে বললেন, উইন্ডোজ ক্রাশ করেছে, দুই হাজার টাকা লাগবে। আমার মাকে কিছু মিথ্যা ওয়াদা দিয়ে দুই হাজার টাকা নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার ভাইকে দিলাম আর উনি যেভাবে ধাপে ধাপে ইনস্টল করছিলেন তা আমি মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। একই সমস্যা কিছুদিন পর আবার ঘটল কিন্তু এবার আমি আর ভাইয়ের কাছে গেলাম না, নিজেই ঠিক করে ফেললাম। এভাবে কিছু সমস্যা নিয়ে ভাইয়ের কাছে যেতাম কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, একই সমস্যা নিয়ে দ্বিতীয়বার যাব না। এভাবে নিজে নিজে অনেক কাজ শিখে ফেললাম এবং আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন শুরু করলাম একটা কম্পিউটার হার্ডওয়্যার প্রশিক্ষণ ও সার্ভিসিং সেন্টার। শুরু হলো আমার আয়রোজগার এবং যেটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে সেটা হলো, আমার পরিচিতি। যে কেউ কম্পিউটার কিনলেই নিয়ে যেত আমাকে এবং কারণে-অকারণে কম্পিউটারের কোনো সমস্যা হলে আবার আমাকেই ডাকত। নিজে ঘাঁটাঘাঁটি আর কিছু বড় ভাইদের সহযোগিতায় কম্পিউটার নেটওয়ার্ক এবং ওয়েব ডিজাইনও শিখে ফেললাম।
বিবিএ পাস করেই বেশ ভালো বেতনে চাকরি পেয়ে গেলাম একটি বহুজাতিক সফটওয়্যার কোম্পানিতে। চাকরিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এবং তিন বছর অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও আমার প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকার জন্য আমি সুযোগ পেয়ে যাই। চাকরি থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে রাতে প্রতিভাবান কিছু তরুণকে নিয়ে একটা যুব সংগঠন চালাতাম এবং তাদের মধ্যে কিছু প্রকৌশলপড়ুয়া তরুণকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলাম আমার সফটওয়্যার স্টার্টআপ দূরবিন ল্যাবস। যেখানে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উন্নতমানের লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা ছিল আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এভাবে দিনের বেলায় চাকরি আর রাতের বেলা নিজের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে থাকলাম। তিন বছরে অর্জিত আমার সব আয় ঢেলে দিলাম স্টার্টআপে। আর পক্ষান্তরে আমার কর্মক্ষেত্রে আমি ভারতের টাটা টেলিকম, দুবাইয়ের ডু টেলিকম, রোমানিয়ার রোম টেলিকম প্রভৃতি বড় কিছু প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম এবং পরিশ্রমের ফলস্বরূপ তিন বছরে পাঁচ ধাপ পদোন্নতি পেয়ে হয়ে গেলাম ম্যানেজার।
পাশাপাশি তরুণদের নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে যাই বৃত্তি এবং সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা। এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও আমি থেকে যাই দেশে। কারণ আমার সব স্বপ্ন এ দেশকে ঘিরেই। এ ছাড়া যুবকদের নিয়ে আমার প্রকল্প নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশের যুব কনফারেন্সে। আমার স্টার্টআপের তৈরি দুরবিন অ্যাপ তত দিনে প্রস্তুত হয়ে যায়। আর যেহেতু আমি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত–তাই খুব ভয়ে, নীরবে তা উন্মুক্ত করি ২০১৫-এর জানুয়ারি মাসে। অল্প সময়ে অ্যাপটি ব্যাপক সাড়া ফেলে।
২০১৫ সালে দুরবিন অ্যাপ পেয়ে যায় জাতীয় পুরস্কার এবং ওয়ার্ল্ড সামিট অ্যাওয়ার্ডের ফাইনালিস্ট হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। একই বছর আমরা গ্রামীণফোন ডিজিটাল উইনার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হই এবং টেলিনরের প্রধান কার্যালয়ে বেস্ট এশিয়ান অ্যাপ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই। সে সময় জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হই, চাকরি ছাড়ব। আমার এই সিদ্ধান্তে পরিবারের কেউ সায় দিচ্ছিল না আবার সেই সময় আমার কোনো সঞ্চয়ও ছিল না। এই সবকিছু মাথায় রেখে মা-বাবাকে বড় কিছু শর্ত দিয়ে ব্যাংকের ২০ হাজার টাকা হাতে নিয়ে ছেড়ে দিলাম চাকরি। পাড়ি দিই নরওয়েতে এবং বেস্ট এশিয়ান অ্যাপ প্রতিযোগিতায় রানারআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করি।
দেশে ফিরে শুরু করি নতুন যাত্রা, ছোট এক রুমের চিলেকোঠায়। দুই মাস পরেই সরকারি এক মন্ত্রণালয়ের বড় প্রকল্পে সফটওয়্যার এবং মোবাইল অ্যাপ বানানোর কাজ পেয়ে যাই। আমাদের প্রথম প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে আমাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। বিভিন্ন কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি খুঁজতে থাকলাম নতুন বাজার। আমরা খোঁজ পাই মধ্যপ্রাচ্যের এক বহুজাতিক সফটওয়্যার কোম্পানির, যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হয় এবং বাংলাদেশে এসে আমাদের অফিস ও কাজ দেখতে চায়। সে সময় ঘটে গুলশান ট্র্যাজেডি, তৈরি হয় আশঙ্কা কিন্তু আমাদের প্রতি আস্থা অবিচল থাকায় তারা বাংলাদেশে এসে চুক্তি স্বাক্ষর করে। আমরা বছরে ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি করতে পারব।
আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা এখন অনেক বড়। আমার মতো প্রকৌশলী না হয়েও আপনারা তথ্যপ্রযুক্তির ক্যারিয়ার গড়তে পারেন। যেমন: প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, সলিউশন আর্কিটেকচার, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, বিজনেস এনালিস্ট, রিসার্চ এনালিস্ট, টেস্টার, টেকনিক্যাল সলিউশন, ভিজ্যুয়ালাইজার, অনলাইন মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, অ্যানিমেশন, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, টেকনিক্যাল ব্লগ লেখা প্রভৃতি।
যাঁরা তথ্যপ্রযুক্তিতে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাঁদের প্রথমে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে। গোলপোস্ট ছাড়া যেমন ফুটবল খেলে কোনো লাভ নেই, তেমনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির ক্যারিয়ারের দিকে অগ্রসর হওয়া ভিত্তিহীন। মনে রাখতে হবে আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। যেমন, আমার বন্ধু অনলাইনে অনেক টাকা আয় করে আমিও আয় করতে চাই—এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল। আপনাকে বুঝতে হবে আপনি কোন কাজে আনন্দ পান এবং কোন কাজ আপনাকে আসক্ত করে। আপনাকে মনে রাখতে হবে সাফল্যের পরিমাপ আপনার ইচ্ছার গভীরতার ওপর নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, আপনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা সবকিছুতে একটু তাড়াহুড়া করি এবং স্বল্পমেয়াদি কাজে বেশি মনোযোগী হই। যেমন, টেম্পপ্লেট দিয়ে ওয়েব ডিজাইন করা, এসসিও, ব্লগ সাইট, ২০০০ ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ওপেন করা, ডেটা এন্ট্রি প্রভৃতি কাজ করে অল্প কিছুদিন আয় করা গেলেও এর ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। আপনাদের এমন কিছুতে দক্ষতা বাড়াতে হবে যা আপনাকে ১০-২০ বছর উপার্জনে সহায়তা করবে। এর জন্য যেকোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী বা মাস্টার হতে হবে।
সব সময় মনে করবেন আপনি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। আপনার জীবনের সিইও আপনি নিজেই, আপনার সাফল্য এবং ব্যর্থতা নির্ভর করবে আপনার সিদ্ধান্তের ওপর। আপনাকেই আপনার সমস্যা সমাধানের অধিনায়ক হতে হবে, তাদের পরাজিত করে সফল হতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে আমিই পারব এবং এটা করে আমি অনন্য হব। আমি আমাকে, আমার পরিবার এবং বাংলাদেশকে সারা পৃথিবীর কাছে নতুন করে পরিচিত করব।