বাংলাদেশি কাঁকড়ার বিশ্বজয়
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১৯৭৭ সালে যে কাঁকড়া রপ্তানি শুরু হয়েছিল—তা এখন যাচ্ছে বিশ্বের ১৮টি দেশে এখানেই শেষ নয়। দেশের প্রায় ১৫ প্রজাতির কাঁকড়াই বিদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় এবং সুস্বাদু হওয়ায় বিশ্ববাজারে রপ্তানির অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশে কাঁকড়া আহরণের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার সুন্দরবন। তবে বাড়তি দামের আশায় ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকারে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মহোৎসবও চলছে। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৭ সালে মাত্র ২ হাজার ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি হতো। এখন তা বেড়ে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হয়েছে ২৩ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার ৬৫৫ মার্কিন ডলার। ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে বিদেশে প্রথম কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। এরপর রপ্তানি বন্ধ থাকে প্রায় ৩ বছর। ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে আবার বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা বাড়ায় রপ্তানি আয়ও বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে ইপিবি ভাইস-চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা—সিইও মাফরুহা সুলতানা বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি কাঁকড়ার চাহিদা আছে। কিন্তু কাঁকড়ার চাষটা ঠিকমতো হচ্ছে না। অধিকাংশই স্থানীয় বা প্রাকৃতিক কাঁকড়া রপ্তানি করা হচ্ছে। এখন পরিবেশেরও একটা বাধা আছে। তাই এটা বেশি উৎসাহিত করলে পরিবেশের জন্য সমস্যা আছে। তবে রপ্তানিকারকরা বলছেন, তারা চাষ করেই রপ্তানি করছেন।
মত্স্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়টি ঠিক করতে হবে। যেন প্রাকৃতিক কাঁকড়া রপ্তানি না করে, আমদানি করা পোনা দিয়ে কাঁকড়া চাষ করে রপ্তানি করা উচিত। ইপিবি জানিয়েছে, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশ্বের ১৮টি দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশি কাঁকড়া। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, চীন, জাপান, চেক রিপাবলিক, জার্মানি, হংকং, কোরিয়া, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, সেনেগাল, থাইল্যান্ড এবং তাইওয়ান। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, কাঁকড়া সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় চীনে। এ ছাড়া প্রতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা উৎসব হয়।
এ সব উৎসবের খাদ্য তালিকায় ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ফলে দামও বেশি। আর বাড়তি দামের আশায় ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকারে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলছে মহোৎসব। প্রাকৃতিকভাবে কাঁকড়া দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ১৮০ গ্রাম ওজনের হয়। ফলে স্থানীয় বাজারমূল্য হয় প্রতি কেজিতে ৫শ থেকে ৬শ টাকা। বিদেশে জীবিত কাঁকড়াই রপ্তানি করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঁকড়ার বাজার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সাল থেকে সনাতন পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পুকুরে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে হংকংয়ে কাঁকড়া বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানির মাধ্যমে শুরু হয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান স্কুলের ডিন কাঁকড়া গবেষক অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসানের মতে, দেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া আছে। দেশের উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে আহরিত কাঁকড়াই বিদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় এবং সুস্বাদু হিসেবে পরিচিতি। তার অভিমত হলো—সুন্দরবনের ওপর কাঁকড়া সরবরাহ নির্ভর না করে পোনা উৎপাদন এবং ফ্রোজেন করে কাঁকড়া রপ্তানি করতে পারলে বাংলাদেশ আরও বেশি লাভবান হবে। পাশাপাশি সরকারিভাবে বিশ্ববাজার খুঁজে ফ্রিজিং করা কাঁকড়া রপ্তানি করার উদ্যোগ নিলে এ খাতে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার— আইইউসিএন জানিয়েছে, ঢালাওভাবে কাঁকড়া রপ্তানির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। কাঁকড়ার বেশকিছু প্রজাতি আইইউসিএনের কালোতালিকায় বা রেডলিস্টে (বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকা) আছে। ফলে কাঁকড়ার চাষ সম্পর্কে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে হবে। বর্তমানে ১২ প্রজাতি কাঁকড়ার মধ্যে ২ প্রজাতির কাঁকড়া মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। সামুদ্রিক সাঁতারু কাঁকড়া ও তিন দাগবিশিষ্ট সাঁতারু কাঁকড়া বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায় উঠে আসায় সরকার এই দুই প্রজাতির কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। স্ত্রী কাঁকড়ার প্রজননের সময় এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকাকালে শিকার নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রের তথ্যমতে, আশির দশকের শুরুতে প্রথম অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়। দেশের পাঁচ উপকূলীয় এলাকায় এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে কাঁকড়ার। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা আর কক্সবাজারের অনেক চিংড়ি চাষি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আর আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দরপতনের কারণে এখন কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার টন কাঁকড়া রপ্তানি করছে।![]()
