কর্মসংস্থান বিকল্প পথে
- সুকুমার ঢালী
অধিক জনসংখ্যার এ দেশ, অতি ঘনবসতির এ দেশ। দেশে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও শিক্ষাবঞ্চিত_ এ তিন স্তরেই কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান খুবই কম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সেভাবে বাড়ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে যথাযথ কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচলিত কর্মসংস্থানের পদ্ধতি অনুসরণ করে কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। প্রয়োজন কর্মসংস্থানের জন্য নতুন কৌশল। ভিন্ন পথে, ভিন্ন মাত্রায় যেতে হবে এ সমস্যা সমাধানের জন্য।
এক তথ্যে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর পেশাগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ পেশা একবিংশ শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন পেশার। প্রযুক্তিমুখী পেশার চাহিদা বাড়বে। আবার বর্তমান প্রযুক্তিকে পাল্টে দিয়ে নতুন প্রযুক্তি এসে স্থান দখল করবে। প্রযুক্তি হবে আরও শক্তিশালী।
আমেরিকার বিশিষ্ট লেখক রিচার্ড রাইট-এর লেখা বই ‘আমেরিকান হাঙ্গার’। এ বইয়ে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিককার আমেরিকার জীবন ও দারিদ্র্যের বর্ণনা রয়েছে। ১৯১০-২০ সালের দিকে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা ও বাংলাদেশের আজকের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমেরিকায় ১৭৭৪ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, শতকরা ২৯ জন লোকের কোনো সম্পত্তি ছিল না। ওই সময়ে সেখানে ভূস্বামী ছিল শতকরা ২০ জন এবং এরা ছিল ৫০-৬০ ভাগ জমির মালিক।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন ইতিবাচকভাবে বদলে যাচ্ছে। তবে বেকার মানুষ বেড়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্করভাবে। কর্মসংস্থানের বহুমুখী ও ভিন্নমুখী পথ এখনই সৃষ্টি করতে না পারলে ভবিষ্যতে এ সমস্যাটি দেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।
কর্মসংস্থানের নতুন পথ সৃষ্টি, কর্মসংস্থানের জন্য দেশ-বিদেশে অনুসন্ধান, প্রচলিত সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে আরও কর্মসংস্থান, কর্মসংস্থানমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের নানা দিক নিয়ে শিক্ষা দেওয়া এসব বিষয় নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
বেসরকারি বিচার বিভাগ, প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা, বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা, সেবা ও নিরাপত্তা বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা গ্রাম থেকে শহরে গড়ে তোলা যেতে পারে। সেবা খাত এখন অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। বাড়ছে মানুষের ভ্রমণ ও বিনোদন চাহিদা। ভোগভিত্তিক সমাজে ভোগের চাহিদা বেড়েই চলেছে।
দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগগুলো কাজে লাগানো দরকার। বর্তমানে বিদেশে আমাদের প্রায় এক কোটি নারী-পুরুষ কাজ করছে। তারা যদি সবাই আরও একজনকে দেশ থেকে নিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাহলে বিদেশে আরও এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। এ জন্য দরকার প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণ।
বাংলাদেশের নাগরিকরা পৃথিবীর বহু দেশে কাজ করছে। তবে পৃথিবীর সব দেশে কি আমরা যেতে পেরেছি? প্রয়োজন কর্মসংস্থানের সন্ধানে সরকারি-বেসরকারি টিম বিভিন্ন দেশে পাঠানো এবং এসব বিষয়ে অনুসন্ধান করা। কৃষি, অকৃষি, শিল্প, সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য_ নানা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে বিভিন্ন দেশে। প্রয়োজন যথাযথ অনুসন্ধান।
বাংলাদেশের মানুষ সবাই আন্তর্জাতিক মানের না হলেও আন্তর্জাতিক মনের। চাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে চায় কোটি কোটি মানুষ। নিজের ঘরবাড়ি, সম্পদ বিক্রি করে বিদেশ যেতে প্রস্তুত লাখ লাখ মানুষ। এ জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। চোরাপথে বিদেশযাত্রায় সাগরে, জঙ্গলে অকালমৃত্যু এখন অহরহ বিষয়। এশিয়া-আফ্রিকার মানুষ কাজের সন্ধানে ছুটছে ইউরোপ-আমেরিকায়। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। মিডিয়ার কল্যাণে এসব অমানবিক দৃশ্য আমরা দেখছি। জাহাজডুবি, নৌকাডুবি, শারীরিক নির্যাতন, জেল-জুলুম দেখেও এ তৎপরতা বেড়েই চলেছে।
এ কথা সত্য যে, ইউরোপ-আমেরিকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম। অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে এশিয়া-আফ্রিকা। এসব এলাকার মানুষ কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার দিকে কাজের সন্ধানে ছুটবে_ এটাই স্বাভাবিক। দারিদ্র্য পাসপোর্ট ছাড়াই ঘুরে বেড়ায় সারা পৃথিবী। ভিসামুক্ত পৃথিবীর দাবিতে দেশে দেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে। এটি এখন সময়ের দাবি। ওরা কাজ করে খেতে চায়। ওরা নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে দেশে দেশে সমৃদ্ধি চায়। বিনিময়ে চায় মাস শেষে বেতন। বেঁচে থাকার লড়াই, সমৃদ্ধ জীবন যাপনের জন্য লড়াই চলছে সৃষ্টির আদি থেকে। গোটা পৃথিবী আমার দেশ, আমার ঘর। আকাশ হচ্ছে সে ঘরের ছাদ।
কথায় বলে বাধা যেখানে প্রবল, আকর্ষণ সেখানে তীব্র। কোটি কোটি বেকার এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে যাবে কাজের সন্ধানে; উন্নত জীবন যাপনের আশায়। বাধা যত প্রবল হবে, যাওয়ার আকর্ষণও তত তীব্র হবে।
এক সময় ব্রিটিশ, ফ্রেন্স ও স্প্যানিশ কলোনি ছিল সারাবিশ্বে। এরা ইচ্ছেমতো শাসন করেছে। পরাধীন করে রেখেছিল গোটা বিশ্বকে। বিশ্বের দেশগুলোর সম্পদ লুুট করে গড়ে উঠেছে ইউরোপের সভ্যতা। দীর্ঘ দিন এদের কলোনি থেকে উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া এসব দেশের নাগরিক শুধু কাজের সন্ধানে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবেশ করতে চায়। বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানে সমতা প্রয়োজন। বেকার মানুষ শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়; গোটা পৃথিবীর সমস্যা। বেকার সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা- এভাবে ভাবা উচিত। বাংলাদেশের বেকার সমস্যা শুধু সরকারের সমস্যা নয়। এটি একটি জটিল জনসমস্যা। উন্নয়নে বেসরকারি উদ্যোগ, বেকার সমস্যা সমাধানে বেসরকারি উদ্যোগ এখন বেশি প্রয়োজন। স্ব-উদ্যোগে কর্মসংস্থানের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাজীবন শেষে শুধু চাকরি নয়; নিজে উদ্যোক্তা হয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং অন্যদেরকে কর্মসংস্থানে উৎসাহিত করতে হবে তরুণ সমাজকে। যেহেতু বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ, তাই এখানে কর্মসংস্থানের বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও কর্মসংস্থানের বিভিন্ন পথ এখনই বের করতে হবে। গ্রাম থেকে আসা মানুষের চাপ রাজধানী শহরসহ বিভিন্ন জেলা শহরে বাড়ছে। দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়বে, যদি গ্রামে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা হয়। যারা স্ব-উদ্যোগে কর্মসংস্থান করতে চায়, অর্থের অভাবে তারা এগুলো করতে পারছে না।
গ্রাম পর্যায়ে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রতিটি গ্রামে বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ (অফিস নয়) স্থাপন করে সপ্তাহে ১/২ দিন প্রাথমিক পর্যায়ে চালু করা যেতে পারে। এখানে গ্রামের মানুষ অ্যাকাউন্ট খুলবে এবং ছোটখাটো ঋণ নিয়ে ব্যবসাসহ নানা কাজে অংশ নিতে পারবে। গ্রামে থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে শহরে আসার প্রবণতা কমবে।
রাজধানী শহরে অফিসগুলো দু’শিফটে চালু করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাংক, বীমা, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে এ কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। একই অফিস স্পেস ব্যবহার করে দু’শিফটে কাজ শুরু হলে খরচ যেমন কমবে, তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পর্যায়ক্রমে এসব উদ্যোগ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও চালু হতে পারে।
প্রত্যেক মানুষ কাজ চায়, স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকতে চায়। নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে কাজ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কাজের মধ্য দিয়েই একটি জাতি অগ্রগতির দিকে যাবে। দেশের বিরাট একটি অংশকে বেকার রেখে পূর্ণাঙ্গ অগ্রগতি সম্ভব নয়। কর্মসংস্থানের দিকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ জন্য প্রচলিত ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কর্মসংস্থানে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে।
সুকুমার ঢালী: মুক্তিযুদ্ধ ও উন্নয়ন বিষয়ক অনুসন্ধানী লেখক