বিশ্বসেরা শিক্ষকের তালিকায় শাহনাজ
- লিডারশিপ ডেস্ক
‘স্কুলে যাতায়াতের পথে প্রায়ই ইভ টিজিংয়ের শিকার হতাম। বখাটেদের ভয়ে টানা ১৫ দিন ঘরে বসে শুধু কেঁদেছি। এরপর আবার স্কুল। বখাটেদের ভয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা–মা বিয়ে দিলেন। বাল্যবিবাহের কারণে স্বপ্ন ভেঙে গেল। তবে তাতে হাল ছাড়িনি। কষ্ট–সংগ্রাম করে এত দূর এসেছি।’ বগুড়ার শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ পারভীনের সঙ্গে কথা শুরু হয়েছিল এভাবেই।
শাহনাজ পারভীনের এই ‘এত দূর’ আসা আসলে কত দূর? আর কেনই–বা তিনি এখন পাদপ্রদীপের আলোয়। কারণটা শুধু শাহনাজের নিজের জন্যই নয়, দেশের জন্যই গৌরবের। বিশ্বের সেরা ৫০ শিক্ষকের তালিকায় উঠেছে শাহনাজ পারভীনের নাম। বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত গ্লোবাল টিচার পুরস্কার জিতলে আরও ভালো লাগবে।’ ১৮ ডিসেম্বর শেরপুর উপজেলা সদরের টাউন কলোনি–শান্তিনগরে তাঁর বাড়ির পাশে পথশিশু ও প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়ে বসে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
বিশ্বের সেরা শিক্ষক নির্বাচনের জন্য ২০১৫ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ভারকি ফাউন্ডেশন ‘গ্লোবাল টিচার পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে। এ বছর বিশ্বের ১৭৯টি দেশের ২০ হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে শীর্ষ ৫০ শিক্ষককে বাছাই করা হয়েছে। এই তালিকায় ১৬ জন নারীর মধ্যে আছে বাংলাদেশের শাহনাজ পারভীনের নাম। মনোনয়ন পাওয়া ৫০ জনের মধ্য থেকে আগামী বছরের ১৯ মার্চ দুবাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। বিজয়ীকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হবে ১০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালে ফিলিস্তিনের সামিহা খলিল সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক হান্নান আল হুরাব এবং ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টিচিং অ্যান্ড লার্নিং সেন্টারের শিক্ষক ন্যানসি অ্যাটওয়েল গ্লোবাল প্রাইজ জেতেন।
ঘড়ির কাঁটা সকাল নয়টায় গড়ানোর আগেই বিদ্যালয়ের পথে পা বাড়ালেন শাহনাজ পারভীন। আমরাও সঙ্গী হলাম। নিজের জীবনের কথা বলতে থাকেন শাহনাজ পারভীন, ‘যৌথ পরিবারের বাড়ির বড় বউ। সব দায়িত্ব কাঁধে এসে চাপল। দিনভর খাটাখাটনির পর রাতে শাশুড়ির পানবাটায় সুপারি কেটে দিয়ে পরদিন কী দিয়ে রান্না হবে, তা বুঝে নিতে হতো। সংসারের রান্না, শ্বশুর–শাশুড়ির সেবা, ননদ–দেবরের আদর–যত্ন থেকে সবকিছুই সামলাতে হতো। সকালের রান্নাবান্না শেষে ক্লাসে যেতাম। বিকেলে ক্লাস থেকে ফিরে ফের রসুইঘরে। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই যখন ঘুমাতে যেত, আমি রাত জেগে পড়তাম।’
এভাবে ১৯৯২ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে আলিম পরীক্ষায় মেধা তালিকায় সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় হন শাহনাজ। মেডিকেল কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। ‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির আপত্তির কারণে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। ভর্তির পর কোল আলো করে কন্যাসন্তান এল। রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। মেয়েকে দোলনায় শুয়ে রেখে পায়ের নখের সঙ্গে দড়ি বেঁধে টান দিতাম আর রাতভর পড়াশোনা করতাম। সকালে মায়ের কাছে ওকে রেখে কলেজে যেতাম।’
এভাবেই স্নাতক–স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিলেন শাহনাজ পারভীন। স্নাতকে পড়ার সময় বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। ২০০৩ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। বিএড, এমএডসহ বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেন এবং প্রশিক্ষণ নেন। শাহনাজ পারভীন বললেন, ‘শৈশবে খেলার সঙ্গীরা মাটির খেলনা দিয়ে “সংসার–সংসার” খেলত। আমি খেলতাম “স্কুল–স্কুল”। ওই বয়সেই ঘর এঁকে শিক্ষার্থী পড়াতাম। তবে বাবা–মায়ের ইচ্ছা ছিল চিকিৎসক হই। বাবা–মা দুজনই ছিলেন শিক্ষক। অল্প বয়সে যাঁর সঙ্গে বিয়ে হলো, তিনিও শিক্ষক।’ এ কারণেই আপাদমস্তক নিজেকে শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা জাগে শাহনাজ পারভীনের মনে।
শেরপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের পর প্রথমে পড়ানো বিষয়টা তেমন বুঝতেন না। প্রধান শিক্ষক নাজির উদ্দিন হাতেকলমে তা শিখিয়ে দেন। ‘এরপর ভালো শিক্ষক হওয়াটাই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। ঝরে পড়া রোধ করার পাশাপাশি পাঠদানকে আনন্দময় ও কোনো বিষয় সহজভাবে শিশুদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করতাম।’ বললেন শাহনাজ। এর ফলও পেলেন তিনি। ২০০৯–১০ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকও নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী শিক্ষক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবার ইউনেসকোর মনোনয়নে ভারকি ফাউন্ডেশনের গ্লোবাল টিচার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন।
গ্লোবাল টিচার পুরস্কারের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ছয়জন শিক্ষকের কাছ থেকে গত ১৩ জুলাই আবেদনপত্র আহ্বান করে। সেই অনুযায়ী আবেদন করেন শাহনাজ পারভীন—জানালেন শেরপুর উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. নার্গিস পারভিন। ১৩ ডিসেম্বর তাঁদের ওয়েবসাইটে সেরা ৫০ জন শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়াতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বাসায় শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন শাহনাজ পারভীন। সেই বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেল, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পড়াশোনার সুযোগের পাশাপাশি বই–খাতা–কলম, স্কুলের পোশাক, ব্যাগ, টিফিন সবই বিনা মূল্যে পাচ্ছে। শাহনাজ বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে আমার দুই মেয়েকে স্কুলবাসে তুলে দিতে শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে আসতাম। ছোট সেলুন, চায়ের দোকান, হোটেলে কাজ করত শিশুরা। তারা ফ্যালফ্যাল করে আমার মেয়ের স্কুলব্যাগের দিকে চেয়ে থাকত। একদিন সেলুন শ্রমিক সাদমান ও লেদযন্ত্রের শ্রমিক শামীমকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কি লেখাপড়া করবা? তারা রাজি হলো।’ ২০১৩ সালে দু–তিনজন শিশুকে বাড়িতে ডেকে এনে পড়ানো শুরু করলেন শাহনাজ। দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্বামী মোহাম্মদ আলীর সহযোগিতায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে শেরপুর শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করলেন। বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলে এ স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম। বর্তমানে এ স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০। শিক্ষার্থীরা সবাই কর্মজীবী।
শাহনাজ পারভীনের দুই মেয়ে। মাসুমা মরিয়ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক এবং ছোট মেয়ে আমেনা মুমতারিন বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।