পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
খাদ্য সম্পর্কিত সমস্ত প্রায়োগিক ধারণার বিস্তার ঘটায় পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান। সারাবিশ্বে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কারণ পুষ্টি ও খাদ্য ছাড়া মানুষের জীবন অকল্পনীয়। একটি মানুষ গর্ভে থাকা অবস্থা থেকে তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত খাদ্য এবং পুষ্টির চাহিদা আবশ্যিক। আর এই আবশ্যিক বিষয়ের জন্য রয়েছে উচ্চ পর্যায়ের লেখাপড়া আর জ্ঞান আহরণের সুযোগ। পুষ্টি ও খাদ্য সম্পর্কিত লেখা পড়ার জন্য রয়েছে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিউট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের (আইএনএফ এস) পরিচালক প্রফেসর ড. আলেয়া মাওলার মতে, ‘খাদ্যের মান নির্ণয় ও পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই কাজ করে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। আর এই পুষ্টি ও খাদ্য ইনস্টিটিউটে রয়েছে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার।’
পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়ালেখা করে স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটসহ স্বাস্থ্য পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে কিংবা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে। সুযোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিও এবং সংস্থাগুলোতেও। এসব এনজিও এবং সংস্থার মধ্যে রয়েছে ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএস, নেসলে, ফাও (FAO), আইসিডিডিআর,বি (IEDDR,B), ইউনিসেফ (UNICEF), হু (WHO) প্রভৃতি। তাছাড়া এই বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর রিসার্চার বা গবেষক হিসেবে ক্যারিয়ারের জন্য বাংলাদেশেও পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। তাই উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানকে পছন্দের তালিকায় যোগ করা কোনোভাবেই ভুল সিদ্ধান্ত হবে না।
এই বিষয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের (আইএনএফএস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আলেয়া মাওলা বলেন, ‘বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্বমানের রিসার্চার বা গবেষক হতে পারবেন এই বিষয়ে।’
পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানের প্রাক্তন পরিচালক এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলা বলেন, ‘একজন চাকরিজীবীর চেয়ে একজন গবেষকের কদর সব জায়গাতেই বেশি। বিশ্বব্যাপী একজন গবেষককে মূল্যায়ন করা হয় একটু বেশিই। তাই গবেষক হওয়ার লক্ষ্য থাকলে তা ক্যারিয়ারের জন্যও ভালো। গবেষক হতে হলে উচ্চশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।’
পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে কী ধরনের ক্যারিয়ার হতে পারে—এমন প্রশ্ন করলে অধ্যাপক ড. আলেয়া মাওলা বলেন, ‘খাদ্য ও পুষ্টি মানুষের প্রধান চাহিদা। খাদ্য ও পুষ্টি ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। পৃথিবীর সব চাহিদার আগে পুষ্টি ও খাদ্য। তাই এর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা নেই। একজন পুষ্টিবিদের বর্তমানে অনেক চাহিদা। দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন এনজিওতে এই বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে চাকরির সুযোগ। তবে এই বিষয়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ালেখা যেমন ভালো করতে হবে, তেমনি ব্যবহারি দিকেও দক্ষতা থাকতে হবে। মোট কথা, পরিপূর্ণ যোগ্যতা থাকতে হবে।’
পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সদ্য উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী মো. সোহরাব আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা অন্য বিভাগের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্যারিয়ার গড়ছে। আমরা যারা এই বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তারা প্রত্যেকেই কর্মজীবনে দ্রুতই খুব ভালো অবস্থান অর্জন করতে পেরেছি। এই বিষয়ের সংশ্লিষ্ট চাকরিতে শুরুতেও ভালো বেতন পাওয়া যায়।’
এনজিও ছাড়াও আরও অনেক জায়গাতেই পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রাধান্য রয়েছে। তার উদাহরণ দিতে গিয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক ড. গোলাম মওলা বললেন এই বিভাগের এমন এক শিক্ষার্থীর কথা যিনি কর্মরত রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাতে।
পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে আগে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার নিয়ে ভীতি ছিল। এই বিভাগটি নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ বলেও এক ধরনের ধারণা গড়ে উঠেছিল। সময়ের সাথে সাথে সেই ধারণা দূর হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে। এ বিষয়ে আইএনএফএস পরিচালক ড. আলেয়া মাওলা বলেন, ‘আমাদের দেশে একটা সময় শুধু গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজেই (ঢাকা, আজিমপুর) এই বিষয়ে পড়ালেখা করানো হতো। আর এই বিষয়টিতে পড়ালেখার সুযোগ ছিল কেবল মেয়েদের জন্যই। এখন পুষ্টি ও খাদ্য বিষয়ে চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে পাবলিক ও প্রাইভেট অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। আর এই সুযোগও এখন উন্মুক্ত ছেলে-মেয়ে সকলের জন্য। এই এই বিষয়ে আর এখন নারী-পুরুষ কোনো বৈষম্য নেই। যে কেউই এই বিষয়ে পড়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারবে।’
এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী খালেদা হোসেন মুন বলেন, ‘মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও এখন এই ক্যারিয়ার নিয়ে এগুচ্ছে। একটা সময় এই বিষয়কে মেয়েদের বিষয় ভাবা হলেও সেই ভুল ধারণা এখন ভেঙে গেছে।’
উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান এখন দেশের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে নামে ভিন্নতা থাকলেও পাঠ্যসূচি মূলতই অভিন্ন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, নর্দান ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।
এ ছাড়াও দেশের বাইরে এই বিষয়ে পড়ালেখা করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিএসআইআরও) পুষ্টি ও খাদ্য বিষয়ক গবেষণা পরিচালনা করে। আবার ইনস্টিটিউট অব ফুড টেকনোলোজি (আইএফটি) যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যবিজ্ঞান ও খাদ্য প্রকৌশল বিষয়ক বৃহত্তম সংস্থা। ২০১২ সালে এর সদস্য ছিল ১৮,০০০। এটিও একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। খাদ্যবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন বিষয়ে শিক্ষা প্রসার, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মাধ্যমে জনকল্যাণ ও নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যে ইনস্টিটিউট অব ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি (আইএফএসটি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো ছাড়াও ভারত, চীন, মালেশিয়াসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে পড়ালেখা ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে হলে কী করণীয়, সে প্রসঙ্গে ড. আলেয়া মাওলা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে হলে প্রার্থীকে এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বিষয় ছাড়া জিপিএ ৮.০ (পরিবর্তনীয়) থাকতে হবে। প্রার্থীকে ‘ক’ ইউনিটের আওতায় ১২০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শর্তাবলী অনুসরণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে কী কী বিষয় পড়ানো হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে বিভাগের পরিচালক বলেন, ‘পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান অনুষদের অধীনে যেসব বিষয় পাঠ্যসূচি হিসেবে সংযুক্ত করা হয় সেগুলো হলো—ফুড সায়েন্স, ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন, ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, নিউট্রিশন ইন এমার্জেন্সিস, ডেভেলপমেন্ট ফুড কেমিস্ট্রি, হিউম্যান মাইক্রোবায়োলজি, ইন্ট্রোডাকশন টু নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স, মাইক্রো-ইকনোমিকস, হিউম্যান অ্যানাটমি, হিউম্যান ফিজিওলজি, সোশ্যাল নিউট্রিশন, বায়োকেমিস্ট্রি, ম্যাটার্নাল অ্যান্ড চাইল্ড নিউট্রিশন, নিউট্রিশনাল প্রবলেম, নিউট্রিশনাল প্ল্যানিং প্রভৃতি। মোট কথা, খাদ্য ও পুষ্টির সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ই পড়ানো হয় এই বিভাগে।’
সব শেষে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে গতানুগতিক বিষয়ে পড়ালেখা করে ক্যারিয়ার গড়া কঠিন। সেই হিসেবে যারা একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করতে চান, তারা এই বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে এগিয়ে আসতে পারেন।’