ফারহিন-রুমানার ‘শক্তি নেটওয়ার্ক’
- লিডারশিপ ডেস্ক
নারী যেখানেই যায়, বিপদ তার পিছনে রয়। বারবার গলা ফাটালেও যখন টনক নড়ছে না কারোর তখন আর বসে থাকার মানে হয় না। তাই নিজেদের সুরক্ষা করার দায়িত্ব নিজেদের হাতেই তুলে নিচ্ছেন এ যুগের সাহসী মেয়েরা। একাজে জরুরি এমনি এক মাধ্যম ‘শক্তি নেটওয়ার্ক’। এই সংগঠনের কাছ থেকে একজন সদস্য সেই সুবিধাগুলোই পাবেন যেগুলো তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে পেয়ে থাকেন।
ফারহিন কবির। জার্মানির রাইন ওয়াল ইউনিভার্সিটিতে জেন্ডার অ্যান্ড ডাইভার্সিটি স্টাডিজে পড়ছেন। বাড়ি ঢাকার শান্তিনগরে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন মেয়েদের ঐক্য সংগঠন ‘শক্তি নেটওয়ার্ক’। উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছেন প্রিয় বন্ধু রুমানা শারমিন। দুই বন্ধুর চেষ্টাতেই গড়ে উঠেছে সংগঠনটি।
শক্তি মূলত মেয়েদের এলাকাভিত্তিক বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক। পায়ে হাঁটা দূরত্বে বসবাসকারী মেয়েরা ছোট ছোট বন্ধুগ্রুপ গড়ে তোলার মাধ্যমে একতাবদ্ধ হচ্ছে এবং তাদের গ্রুপগুলোকে সমন্বয় করার জন্য রয়েছে এই শক্তিশালী ‘নেটওয়ার্ক’।
শক্তি নেটওয়ার্কে মেয়েরা সবধরনের সুবিধা পেয়ে থাকে, সেটাও মেয়েদের কাছ থেকেই। প্রত্যেকটি এলাকাতেই থাকে শক্তির একটি করে দল– যারা কি না, অন্যদেরকে চাওয়ামাত্র সাহায্য করে। তবে সাহায্যপ্রার্থীকে অবশ্যই ‘শক্তি’র সদস্য হতে হবে। বুঝলেন না? ধরুন, আপনি শক্তির সদস্য। থাকেন শান্তিনগরে। গিয়েছেন উত্তরাতে। এখন আপনার জানা দরকার সেখানে কোন কোন ব্ল্যাড ব্যাংক আছে, কোথায় আছে মেয়েদের হোস্টেল, শপিং মল, লাইব্রেরি কিংবা মেয়েদের জিম। উত্তরার ‘শত্তি’দ্ধর দলটি আপনাকে নিমেষেই সবকিছু জানিয়ে দেবে। রকিব হাসানের বিখ্যাত ‘তিন গোয়েন্দা’ যারা পড়েছেন, তাদের জন্য ব্যাপারটি সহজ একইসঙ্গে মজারও। বিষয়টি তিন কিশোর গোয়েন্দার জনপ্রিয় ‘ভূত থেকে ভূতে’র মতোই।
ফারহিন বললেন, ‘শক্তি’ একটি নিরাপদ প্লাটফর্ম। এখানে মেয়েরা একতা ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও আগ্রহ পূরণ নিজেরাই করতে পারে। নেটওয়ার্ক পরিচালনা করার জন্য রয়েছে একটি আচরণবিধি এবং মডারেটর, গ্রুপ কো-অর্ডিনেটর এবং সক্রিয় নির্বাহী কমিটি। ইতিমধ্যে শক্তি নেটওয়ার্ক নানা উদ্যোগ নিয়েছে। দুই বছরে পাঁচ শতাধিক এলাকাভিত্তিক মেয়েদের আড্ডা হয়েছে। লিডারশিপ ও সেল্ফ্ ডিফেন্সের জন্য আয়োজন করে ওয়ার্কশপ ‘পাওয়ার ক্যাম্প’, পহেলা বৈশাখে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে পোস্টার ক্যাম্পেইন ‘আমার শহর’, এলাকাভিত্তিক সাইকেল প্রশিক্ষণ ও রাইডের উদ্যোগ ‘শক্তির সাইকেল’। ‘কালারস’ এফএম রেডিওতে শক্তি নেটওয়ার্কের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘হাত বাড়ালেই শক্তি’, ‘কান পেতে রই’ এর সঙ্গে নিয়মিত ওয়ার্কশপ, ওয়াওবক্সের সঙ্গে অনলাইন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেন এবং সেলফ ডিফেন্স ক্যাম্পেন, বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে রেডিও আয়োজন ‘ট্যাবু টক’, রোকেয়া দিবসে মেয়েদের সাইকেল র্যালিসহ নানা আয়োজন করেছে শক্তি নেটওয়ার্ক।
ঢাকার শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, পল্টন, রাজারবাগ, কাকরাইল, সেগুনবাগিচা, বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরী, শাহজাহানপুর, শ্যামলী, বাংলামোটর, মগবাজার, ইস্কাটন, তেজগাঁও, কাওরান বাজার, শঙ্কর, জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাব, লালমাটিয়া, নীলক্ষেত, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, গ্রিনরোড, খিলগাঁও, গুলশান, নিকেতন, উত্তরা, ফার্মগেট, কল্যাণপুর, হাতিরঝিল, বাসাবো, রামপুরা, সবুজবাগ এবং এগুলোর আশেপাশের এলাকায় বর্তমানে ‘শক্তি গ্রুপ’ রয়েছে। সব মিলিয়ে সক্রিয় সদস্য পাঁচ শতাধিক। এ ছাড়া অনিয়মিত সদস্য আছে আরো দুই হাজারের বেশি।
একটু পিছনে ফেরা যাক। একবার পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা ভিড়ের মধ্যে নারী লাঞ্ছিত হয়। শক্তি নেটওয়ার্কের দুই প্রতিষ্ঠাতা ফারহিন কবির ও রুমানা শারমিন চিন্তা করেন এমন কিছু করার যার মাধ্যমে নারীরা চাইলেই নারীদের কাছ থেকে সাহায্য পাবে। মেয়েরা একসঙ্গে থাকলে হয়রানির শিকার হবে না। যেখানেই যাক না কেন মেয়েরাই মেয়েদের রক্ষা করবে– এমন ভাবনা থেকেই ‘শক্তি নেটওয়ার্কের’ শুরু।
ঢাকার বাইরে মফস্বল এলাকাতেও ‘শক্তি’র ব্যাপারে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেখানেও ছোট ছোট গ্রুপ করার ইচ্ছা রয়েছে। ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বিদেশেও অনেকে শক্তির গ্রুপ করতে চেয়েছে। শক্তি মেয়েদের লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আনছে– অনলাইনে নয়, অফ্-লাইনে। এই মুহূর্তে তাদের কাজ নেটওয়ার্কিংকে আরো শক্তিশালী করে তোলা।
শক্তির মেয়েরা কেউ ছাত্রী, কেউ সাংবাদিক, কেউ চিকিত্সক, কেউ গৃহিণী, কেউ শিক্ষক, কেউ আইনজীবী, কেউ সমাজকর্মী। একটি নেটওয়ার্কে একত্রিত হয়ে সমাজের নানা পর্যায়ে থেকে আসা মেয়েরা একে অন্যের গল্প শোনেন, একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করেন, নিজের গল্প অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। বাড়ে তাদের দেখা ও ভাবনার গণ্ডি। পেশা বা জীবনযাপনে তারা ভিন্ন, বন্ধুত্বে এক। এক তাদের ভেতরকার তেজ। নিজের এলাকাতেই কোথাও বসে নিয়ম করে আড্ডা দেন তারা।