অনুকরণীয় আখতার
- লিডারশিপ ডেস্ক
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়…।’ ফোন যখন করা হয়েছিল, তখন গানটি শুনছিলেন ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইন। ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় তখন সন্ধ্যা। আর অপর প্রান্ত মেলবোর্নে তখন মধ্যরাত। ফোন করার সময়টা আগেই ঠিক হয়েছিল ই-মেইল যোগাযোগে। জানালেন হুমায়ূন আহমেদের লেখা, তাঁর গানের প্রতি বিশেষ একটা ভালোবাসা রয়েছে। তাই এ গান প্রায়ই শোনা হয়।
বিজ্ঞানী আর গবেষক আখতার হোছাইনের মনটা যে মানুষের জন্য কাঁদে, সেই প্রমাণ তিনি রেখে যাচ্ছেন তাঁর কাজে। মানুষের জরা জয়ের দাওয়াই আবিষ্কৃত হচ্ছে আখতারের হাত ধরে। মানুষের জন্য কিছু করতে পারবেন, সে কারণেও গবেষণায় তাঁর আগ্রহ।
এই সময়ে স্থূলতা বিশ্বজুড়েই অনেক মানুষের জন্য বড় সমস্যা। আবার খাওয়ার প্রতি অনীহাও আছে অনেকের। আখতার হোছাইনসহ একদল গবেষক মানবদেহে থাকা এমন এক অণু আবিষ্কার করেছেন, যা ক্ষুধা কমানো-বাড়ানোর ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিষয়টিকে বৈপ্লবিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ডায়াবেটিস রোগের জন্য ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়, তা রাখতে হয় রেফ্রিজারেটরে। আখতার হোছাইন এমন ইনসুলিন তৈরি করেছেন, যা ফ্রিজ ছাড়াও সংরক্ষণ করা যাবে। হাঁপানির মতো ফুসফুসঘটিত নানা রোগের নিরাময়ে সম্ভাব্য ওষুধও বানিয়েছেন আখতার হোছাইন। এগুলো তাঁর সাম্প্রতিকতম গবেষণার কাজ। আখতার হোছাইন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোরে নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটের ইনসুলিন পেপটাইডস ল্যাবের প্রধান। রসায়ন কিংবা প্রাণরসায়নের বিশ্বখ্যাত প্রায় সব জার্নালেই আখতারের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় নিয়মিত। এ পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে অ্যাঙ্গেওয়ানদে কেমি, জেবিসি আর অর্গানিক অ্যান্ড বায়োমলিকুলার কেমিস্ট্রি জার্নালে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একাধিক গবেষণাপত্র। রোগের দাওয়াই নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রটিতে আখতার পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য।
মস্তিষ্কই বলে দেবে আর খেয়ো না
পেটের খিদে আর মনের খিদে বলে কথা প্রচলিত আছে বাংলায়। মনের খিদে থাকলে খাওয়া বেশি হয়। আখতার হোছাইনদের যে আবিষ্কার, তা এই খিদেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আখতার বললেন, ‘ইনসুলিন একটা হরমোন, যেটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। এমন আরও সাতটা হরমোন রয়েছে। তেমনই একটা হলো ইনসুলিন-৫। এর রাসায়নিক গঠন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ইনসুলিনের মতোই। এটি তৈরি হয় বৃহদন্ত্রে (কোলন)।’ ইনসুলিন-৫ নামের হরমোন একদিকে স্থূলতা, অন্যদিকে ক্ষুধামান্দ্য কমাতে সহায়তা করবে। ইনসুলিন–৫ হরমোন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। ক্ষুদ্রান্ত-বৃহদান্ত মিলিয়ে হলো গাট, যার অপর নাম ‘দ্বিতীয় মস্তিস্ক’। এই গাট নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই বিজ্ঞানীদের। আখতার বলেন, ‘কোলনে তৈরি হওয়া ইনসুলিন–৫ খিদে আছে কি না সেই সংকেত পাঠায় মস্তিষ্কে। রক্তে ইনসুলিন–৫–এর পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মস্তিষ্ক তখন শরীরকে খেতে কিংবা না খেতে নির্দেশ দেয়। তাই এই হরমোন বা তার টার্গেটকে নিষ্ক্রিয় করলে খাবারের চাহিদা কমে। আবার যাঁদের খাওয়ার রুচি নেই, এই হরমোন প্রয়োগে তাঁদের খাওয়ার চাহিদা বাড়ে।’
২০০৮ সালে আখতার হোছাইন এই হরমোন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করেন। একটা জার্নালে প্রকাশের পর জাপানের ওষুধ নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান তাকেদা যোগাযোগ করে আখতারের সঙ্গে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা কাজ করেন তাকেদার সঙ্গে। ফলে এই তিন পক্ষের ২২ জন গবেষক মিলে আখতারের তৈরি ইনসুলিন-৫ নিয়ে কাজ শুরু করেন।
বিজ্ঞানী আখতার হোছাইন বললেন, ‘আমরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে সফল হয়েছি। সাধারণ, টার্গেটবিহীন কৃত্রিম ও ক্ষুধার্ত—তিন ধরনের ইঁদুরে প্রয়োগ করা হয়েছে এটি। এখন চলছে মানবদেহের উপযোগী ওষুধ আকারে ইনসুলিন–৫ তৈরির প্রি-ক্লিনিক্যাল গবেষণা। সাধারণত কোনো একটা ওষুধ গবেষণাগারে সফল পরীক্ষার পর বাজারের উপযোগী করতে ৫ থেকে ৩০ বছর সময় লাগে। তাই নির্দিষ্ট করে এখনই বলা যাবে না ওষুধটি কবে বাজারে আসবে।’
কথোপকথনে আখতার হোছাইন বলছিলেন, ‘সব দেশেই যেহেতু স্থূলতা ও ক্ষুধামান্দ্য বেশির ভাগ মানুষের সমস্যা, তাই ইনসুলিন-৫ নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা বেশি। তবে এটা আমার পুরোনো কাজ।’
হাঁপানির দাওয়াই
আখতার হোছাইনের নতুন দুটি কাজ সম্পর্কে জানা যাক। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে ফাইব্রোসিসের সম্ভাব্য ওষুধ। ফুসফুসের ক্ষত সারাতে এ ওষুধ কাজে দেবে। হাঁপানির মতো রোগের নিরাময়ও হতে পারে। আবার ফাইব্রোসিসজনিত হৃদ্রোগেও কাজে দেবে এই ওষুধ। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে তিনি তৈরি করেছেন ডায়াবেটিসের ওষুধও। এসবের জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারের গবেষণা অনুদানও পেয়েছেন আখতার হোছাইন। এ বছর ফাইব্রোসিসের ওষুধ তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকার আখতার হোছাইনকে ৮ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। পাঁচটি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট রয়েছে আখতারের নামে।
পথ মসৃণ ছিল না
মেলবোর্নে গবেষণা করে খ্যাতি ও সাফল্য পাওয়া আখতার হোছাইনের জীবন চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। ১৯৭৪ সালের ১ মার্চ কুমিল্লা সদর উপজেলার অলিপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্ম আখতারের। বাবা আবদুর রহমান ও মা ফাতিমা রহমান। বয়স যখন দুই বছর, তখন মাকে হারান। আখতার বললেন, ‘দাদির কোলে বড় হয়েছি আমি। দাদা, দাদি ও বাবার ইচ্ছায় মাদ্রাসায় পড়ি।’ ধনুয়াখলা মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কুমিল্লা জেলায় প্রথম হন আখতার। এই ফল দেখে তাঁর প্রকৌশলী চাচা খলিলুর রহমান অনেকটা জোর করে কুমিল্লা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন আখতারকে। কেননা ধনুয়াখোলা মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। কুমিল্লায় অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা চালান। এরপর দাখিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন আখতার হোছাইন। এরপর খলিলুর রহমান তাঁর লেখাপড়ার সব দায়িত্ব নেন। আলিম পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর (৯০১) নিয়ে মেধাতালিকায় আবারও প্রথম স্থান অর্জন করেন আখতার। পরের ইতিহাস শুধুই এগিয়ে চলার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর—দুই পরীক্ষাতেই অর্জন করেন প্রথম শ্রেণি। জাপান সরকারের মনবুসো বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে যান টোকিওর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। তাঁর অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘পেপটাইড ড্রাগ সিন্থেসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। এরপর পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা করেন ফ্রান্সের জোসেফ ফুরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৫ সালে আখতার চলে আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। যোগ দেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০১ সালে বিয়ে করেন ফারহানা ফওজিয়াকে। এই দম্পতির দুই সন্তান—আফরাহ তাহসিন ও আরিয়ান হোছাইন।
আখতার হোছাইন গবেষণাকে মনে করেন সৃজনশীল ও চ্যালেঞ্জিং কাজ। বললেন, ‘ভবিষ্যতেও বিভিন্ন রোগের কার্যকর ওষুধ তৈরি নিয়ে গবেষণা করে যেতে চাই। বাংলাদেশের জন্য সব সময় মন টানে আমার। দেশের জন্য যতটুকু পারি, ততটুকু করি নিজের মতো। তবে আমি যে বিষয়ে গবেষণা করি তা খুব ব্যয়বহুল। দেশে এ ধরনের কাজ করার সুযোগ সীমিত।’
আখতার হোছাইনের স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রফিকুর রহমান। আখতার সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘মানুষ হিসেবে সে অসাধারণ। আমাদের এখানে যে খুব ভালো ফল করেছে তা নয়, তবে বিজ্ঞান গবেষণায় তার আগ্রহ সব সময়ই ছিল। এখন তো সে নিবেদিতপ্রাণ। আন্তর্জাতিকভাবে আখতার এখন যথেষ্ট খ্যাতিমান। কিন্তু তার মধ্যে কোনো গর্ব বা অহংকার নেই। মানবসভ্যতার জন্য এ রকম গবেষক প্রয়োজন।’
অস্ট্রেলিয়ায় বসে আমাদের কুমিল্লার সন্তান আখতার হোছাইন এমন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, যা ভবিষ্যতে সব মানুষের কাজেই আসবে। ‘আমি চাই মানুষের কল্যাণে, রোগ জয়ের জন্য আমার গবেষণা চালিয়ে যেতে।’