উন্নয়ন সংগঠনে নারী
- লিডারশিপ ডেস্ক
বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নে সরকারি এবং বেসরকারি অনেক উন্নয়ন সংগঠন কাজ করছে। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী হলেও সংগঠনসমূহে নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক নয়। বিভিন্ন সংগঠনে কর্মরত নারীরা জানিয়েছেন তাদের সমস্যা এবং পরামর্শ।
আফরোজ মহল
আরবান ম্যানেজার, অক্সফাম
আমাদের দেশে এনজিওগুলোর কার্যক্রমে দাতাসংস্থাগুলো অর্থ সরবরাহ করে। নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে দুটো বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। প্রকল্পগুলোতে নারীকর্মীর সংখ্যা এবং প্রকল্প থেকে নারীদের উপকার। ফলে এনজিওগুলোতে নারীদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এতে আবার দুটো অবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রথমত, অনেকে নারী বলে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় আবার অনেকে স্বেচ্ছায় কাজের সুযোগ পায়।
উন্নয়ন সংগঠনগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও উপরের দিকে নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে বাড়ে না। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ মনে করে, পুরুষ যেভাবে সময় দেয়। নারীরা সেভাবে সময় দিতে পারে না। আবার কোনো কাজ দেওয়া হলেও তাকে সহযোগিতা করার জন্য কোনো পুরুষকে দেওয়া হয়। এভাবে কয়েকটি কাজ করার পর নারীর নিজের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সাধারণত নারীদের অফিস শেষ করে বাসায় এসে ঘরের কাজে সময় দিতে হয়। নিজের যত্ন নেওয়ার সময় পাওয়া যায় না। অথচ এ সময়ে কাজের বাইরে কিছু পড়াশোনা করতে পারলে সে চলমান সময়কে ধরতে পারত। অনেক পরিবারে স্ত্রী ভাল চাকরি করুক, তাও চায় না। ফলে নারীর যে উন্নয়ন হওয়া প্রয়োজন তা হয়ে উঠে না।
০০০
সিফাত-ই-আজম
ডেপুটি ডিরেক্টর, আইএনএম
কোনো নারী অফিসে ভাল করলে প্রথম গুঞ্জন আসে নারী সহকর্মীদের থেকে। আবার মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে গেলে পুরুষ সহকর্মীরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। তারা মনে করে, সে তো আরামে থাকবে। এ সময়টিতে অনেক নারী তাদের চাকরি ছেড়ে দেন। পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ-ই অন্য কোনো চাকরিতে যোগ দেন না। সন্তান একটু বড় হলে প্রয়োজন হয় ডে-কেয়ার সেন্টারের। কারণ আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে শুনে থাকি, কাজের মেয়েরা সন্তানদের কষ্ট দিয়ে থাকে। ডে-কেয়ার সেন্টারে সন্তানকে দিলে এ সমস্যা হয় না। সে ভাল পরিবেশ পায়। প্রয়োজন ডে-কেয়ার সেন্টারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো যেতে পারে।
উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত অনেক নারীকে আবার দেখা যায় নারী হিসেবে সুবিধা নেওয়ার। কাজ না করা বা কাজ ফাঁকি দেওয়ার। এক্ষেত্রে নারীদের মনে করা উচিত, অফিস তার কাছ থেকে ৫ আশা করলে ৭-৮ দেওয়ার চেষ্টা করা। এতে অফিসে তার কাজের প্রতি আন্তরিকতা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যাবে।
০০০
মেহেরুন নেছা
সমন্বয়ক, দুর্যোগ ফোরাম
আমার চাকরির শুরুটা ছিল কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামে একটি এনজিওতে। তারা জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করত। আমি প্রজেক্ট অফিসার হিসেবে যোগদান করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে আমি সেভ দ্য চিলড্রেনেও কিছু সময় কাজ করেছি। দুর্যোগ ফোরামে যোগদান করেছি ২০১২ সালে। উন্নয়ন সংগঠনগুলোতে কাজ করতে হলে নিয়মিত মাঠ পরিদর্শনে যেতে হয়। পড়াশোনার সময় নারীরা যত সহজে মাঠ পরিদর্শনে যেতে পারে, বিয়ের পরে সেভাবে যেতে পারে না। কারণ বিয়ের পরে নারীদের চাকরির পাশাপাশি পরিবারকে সময় দিতে হয়। বাচ্চাকে সময় দিতে হয়। একই কারণে অফিসও একজন নারীকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার আগে অনেক চিন্তাভাবনা করে।
এনজিও সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা এখনো স্পষ্ট নয়। এনজিওগুলো দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তারা আর্থসামাজিক নানাক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। সাধারণত আমাদের দেশে এখনো এনজিও বলতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ঋণ বিতরণ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা মনে করা হয়। এসব কাজের বাইরে পরিবেশসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নারীরা কাজ করছে। যা এখনো অধিকাংশ মানুষ জানে না।
০০০
টিয়া খানম
এমফিল গবেষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমি পড়াশোনা করেছি রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে। বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে গবেষণা করছি। আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী এখনো অবহেলিত। তারা তাদের প্রাপ্য অংশগুলো ঠিকমত পাচ্ছে না। স্থানীয় সরকারসহ জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ সংরক্ষিত আসনগুলো নির্বাচন বা মনোনয়নের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। নারী প্রতিনিধিদের জন্য আইনে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব এবং ক্ষমতা থাকলেও অধিকাংশ প্রতিনিধি তা প্রয়োগ করতে পারেন না। এতে জনগণ যেমন তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না, পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নও বিকশিত হয় না।
সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে উন্নয়ন সংগঠনগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। এনজিও এবং সরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, তাদের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত করা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তারা কিভাবে কাজ আদায় করতে পারে- সে সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।
০০০
নভেরা বিনতে নূর
ফিল্ড অফিসার, বিএসটিআই
উন্নয়ন সংগঠনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে পারিবারিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত মনে করা হয়, নারীরা হালকা-পাতলা চাকরি করবে। শিক্ষকতা বা যে সব পেশায় কম সময় দিতে হয়, সেসব পেশায় তারা চাকরি করবে। যেখানে সময় বেশি দিতে হয়, সেখানে তাদের চাকরি করার প্রয়োজন নেই। উন্নয়ন সংগঠনগুলোতে অনেক সময় বেশি সময় দিতে হয়। কাজ শেষ করতে করতে রাত আটটা-নয়টা বেজে যায়। এজন্য অনেকে নারী উন্নয়ন সংগঠনে আসতে চায় না। আবার প্রজেক্টগুলোতে নেতৃত্বের পর্যায়ে কোনো নারীকে দেওয়ার আগে বেশ কয়েকবার চিন্তা করা হয়। কর্তৃপক্ষ ভাবে, সে প্রজেক্ট শেষ করতে পারবে কিনা, কাজে কি পরিমাণ সময় দিতে পারবে এসব বিষয় বিবেচনা করে। ফলে অনেকসময় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নারীদের দেওয়া হয় না।
আমার ক্ষেত্রে বাবা-মা এবং স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছি। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাবা-মা সহযোগিতা করেছেন। অফিস শেষে বাসায় আসতে দেরি হলে আমার স্বামী সন্তানকে দেখে রাখছেন। তারা বুঝেন, অনেক সময় আমি চাইলেই অফিস থেকে ছুটি নিতে পারি না। হাতের সামনে থাকা কাজকে শেষ করে আসতে হয়।