‘ক্লাসের চেয়ে ক্লাসের বাইরে বেশি শিখেছি’
- লিডারশিপ ডেস্ক
ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা এ অ্যান্ড টি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, এ বছর তাঁর লক্ষ্যের কথা।
প্রতিবছর আমি আমার জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ঠিক করি। এ বছর আমার লক্ষ হলো, সান ফ্রান্সিসকোর ছোট্ট গণ্ডি থেকে বের হওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটে আমি গিয়েছি। কিন্তু এখনো অনেক স্টেটে পা রাখা বাকি। ঠিক করেছি, বছর শেষ হওয়ার আগেই আমি সব কটি স্টেটে যাব। মানুষের সঙ্গে কথা বলব। তাঁরা কী ভাবছেন, কী করছেন, কী স্বপ্ন দেখছেন—সব শুনব।
আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি, মানুষের বিচিত্র সব দল বা সংগঠন আছে। দল গঠন করার এই ভাবনাটা দারুণ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের দল, এলাকাভিত্তিক দল, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ মিলেও দল হতে পারে। ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করি। এটা যেমন বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর যোগাযোগ, তেমনি দেশের সঙ্গে দেশের যোগাযোগও। নানা দেশের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দারুণ সুযোগ এখানে আছে। যেন সবাই মিলে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার দিকে আরও মনোযোগী হতে পারে।
নর্থ ক্যারোলিনা এ অ্যান্ড টিতে আসার আগে যতটুকু পড়াশোনা করেছি, তাতে জেনেছি, আপনাদের এখানে দারুণ সব দল আছে। দলগুলো প্রকৌশল ও বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছে। আপনারা নিশ্চয়ই এই সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে গর্বিত।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন মানুষে মানুষে অনেক বিভেদ। অনেকেই ঠিক দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না, কোন পথে যাবেন। শুধু এ দেশেই নয়, ইউরোপ, এশিয়া, সারা বিশ্বেই এক অবস্থাটা। এ অবস্থায় একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা কী দায়িত্ব পালন করতে পারি? আমি অনেকের সঙ্গে কথা বললাম। কিছু বই পড়লাম। জানলাম, মানব ইতিহাসে দলগঠন খুব গুরুত্বপূর্ণ। হাজার বছর ধরে মানুষ একটা বড় দল হতে চেষ্টা করেছে। পরিবার থেকে গোত্র, গোত্র থকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে দেশ, দেশ থেকে জাতি…এভাবে আস্তে আস্তে মানুষ নিজের দলটা বড় করতে শিখেছে। একা যে সমস্যার সমাধান করা যায় না, মানুষ দল বেঁধে সেই সমস্যার সমাধান করেছে।
আমার মনে হয় এখন আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, যখন সমস্যাগুলো শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা একটা জাতি হিসেবে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের এক হওয়া প্রয়োজন। যেমন বৈশ্বিক উষ্ণতার কথাই ধরুন। কিংবা কোনো রোগ, যেটা এক দেশ থেকে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অথবা সিরিয়ার শরণার্থী পরিস্থিতির কথা ভাবুন। এই সমস্যা কোনো দেশের নয়, কোনো গোত্রের নয়, এই সমস্যা সারা পৃথিবীর। ফেসবুক আমাদের সেই অবকাঠামোটা তৈরি করে দিয়েছে, যেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ এক হতে পারে।
আজকের সময়ে আরেকটা বড় ইস্যু হলো তথ্যবিভ্রাট। ভুল তথ্যের কারণে শুধু ফেসবুকই নয়, অনেক সংবাদমাধ্যমও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফেসবুকে ‘থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকার’-এর মাধ্যমে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করছি। অনেকেই স্রেফ কিছু টাকার জন্য ভুল তথ্য পরিবেশন করে। যেমন ধরুন কেউ লিখল, ‘হার্ট অ্যাটাকে জনি ডেপ মারা গেছেন!’ এ রকম অদ্ভুত কিছু লিখে তারা ‘ক্লিক’ পেতে চেষ্টা করে। আপনি সেখানে ক্লিক করলেই একটা ওয়েবপেজে পৌঁছে যাবেন, যেখানে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন আছে। এই বিজ্ঞাপন থেকে তারা আয় করে। একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা মিথ্যা খবর ও ভুল তথ্যের বিপক্ষে লড়ছি। ফেসবুকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে, আমরা এসব খবরকে উৎসাহিত করি। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। আমরা চাই না কেউ ভুল তথ্য পাক।
কোন তথ্যটা ঠিক, আর কোনটা ভুল, সেটা যাচাই করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটা ব্যাপার হলো, একটা তথ্যের সঙ্গে একমত নই বলে আমি তথ্যটা ভুল বলে দাবি করতে পারি না। গণতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আমার মতের সঙ্গে আরেকজনের মত না মিললেও আমি অন্তত সেটা প্রকাশ করতে পারব।
কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে যারা পড়ালেখা করছ, অনেকেই হয়তো আমার কথার সঙ্গে একমত হবে। আমি ক্লাসে যতটা শিখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি শিখেছি ক্লাসের বাইরে। নিজের আগ্রহে কোডিং করেছি। ফেসবুকে কাউকে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এই বিষয়টা মাথায় রাখি। ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করি, পড়ালেখার বাইরে, কাজের বাইরে তুমি কী করেছ? অবসরে একজন মানুষ কী করে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে বোঝা যায় কার আগ্রহের জায়গা কোনটা, নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা আছে কি না। আমি যা শিখেছি, তার বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স বা অফিশিয়াল কাজের বাইরে পাওয়া। আগেই বলেছি, প্রতিবছর আমি আমার জন্য একটা লক্ষ ঠিক করি। গত বছর যেমন আমার লক্ষ্য ছিল, আমার বাসার জন্য একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ‘সিস্টেম’ তৈরি করব। দারুণ মজা পেয়েছি কাজটা করে। অনেক কিছু শিখেছি। এবার স্টেটগুলোতে ঘুরেও অনেক কিছু শিখছি।
কেউ যখন আমাকে প্রশ্ন করে, জীবনের কোন অর্জনটা আপনাকে সব চেয়ে আনন্দ দেয়? আমি বলি, আমার পরিবার। অপূর্ব স্ত্রী আর আদরের মেয়েকে নিয়ে আমার পরিবার। কদিন আগেই জানিয়েছি, আমাদের ঘরে আরও একটা কণ্যা সন্তান আসছে। এটাও একটা ভীষণ আনন্দের খবর। আমার মেয়ের বয়স এক বছর। সে পানি খুব পছন্দ করে, গোসল করতে খুব ভালোবাসে। যখন মেয়েকে আমি গোসল করাই, সেই মুহূর্তটা আমার কাছে সবচেয়ে সেরা মনে হয়। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন আমি সময় বের করতে চেষ্টা করি যেন বাড়ি ফিরে মেয়েকে গোসল করাতে পারি। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মা-বাবা হওয়ার পর পৃথিবীর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আচমকা বদলে যায়! এই পরিবর্তন আমি উপভোগ করছি। (সংক্ষেপিত)