কিশোরী সালিহার অনন্য উদ্ভাবন
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
‘প্রথা ভেঙে কোনো কাজ করতে গেলে সবাই বাধা দেবে, এটাই স্বাভাবিক। চারপাশের মানুষ যতই বলুক তুমি পারবে না, সাফল্য ধরা দেবে ওই পা টেনে ধরা “না” কে না বলার মাধ্যমেই।’ বলছিল সালিহা রেহানাজ। ‘না’কে ‘না’ বলেই সাফল্য পেয়েছে এই কিশোরী। নারীর নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সালিহা উদ্ভাবন করেছে পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি ন্যাপকিন। আর এই উদ্ভাবনের পথ ধরে সে অর্জন করেছে ‘গুগল সায়েন্স ফেয়ার ২০১৬’-এর ‘গ্লোবাল ফাইনালিস্ট’ খেতাব, যা তাকে আরও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।
সালিহা থাকে থাইল্যান্ডে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হলেও বাবার কাজের সুবাদে ভিনদেশে বড় হয়েছে সে। তবে পড়াশোনার জন্য বড় একটা সময় কেটেছে নিজের দেশে। কদিন আগে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে, মাসিক সাময়িকী বিজ্ঞানচিন্তা আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সালিহা শুনিয়েছে তাঁর গল্প।
কয়েক বছর আগের কথা। চট্টগ্রামে নিজেদের বাড়িতে ছিল সালিহা। সে সময় ঋতুস্রাবের জন্য চাচির কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন চাইতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল, এখানে বিষয়টা যেন খুব ‘গোপন’ কিছু। ব্যবহার শেষে সালিহা যখন জানতে চায় সে ময়লা ন্যাপকিন কোথায় ফেলবে, চাচি তাকে বাড়ির পেছনের ময়লার স্তূপ দেখিয়ে দেন। সে সময়ের ছোট্ট মেয়েটা দেখে অবাক হয়, শুধু তাদের বাড়িতে নয়, গ্রামের প্রতিটি বাড়ির পেছনেই এমন ময়লার স্তূপ আছে। যেখানে সাধারণ ময়লার সঙ্গে ন্যাপকিনও ফেলা হচ্ছে। পরে সালিহা ইন্টারনেট ঘেঁটে জেনেছে, একজন নারী সারা জীবনে ১৪ থেকে ১৬ হাজার স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। অন্যদিকে এ রকম একটি ন্যাপকিন প্রকৃতিতে নষ্ট হতে সময় লাগে প্রায় ৫০০ বছর! সামান্য এই তথ্য চিন্তার খোরাক জোগায় কিশোরী সালিহা রেহানাজের মনে। সে ভাবতে বসে, নারীদের নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও একটা কিছু করা দরকার। আশপাশের মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে খুব একটা ফল হয় না। কারণ, গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে মেয়েদের মাসিক নিয়ে কথা বলাও যেন পাপ! বোন অনিলার পরামর্শে নানা রকম উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে সে। দীর্ঘদিন পরিশ্রমের পর অবশেষে নারকেলের খোসা, পাট আর সামান্য সুতি কাপড় দিয়ে তৈরি হয় পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি ন্যাপকিন। এটি যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি এর খরচও কম। সালিহা তখনো জানত না, এই আবিষ্কার তাকে গুগলের পুরস্কার এনে দেবে!
২০১৬ সালে হঠাৎ ‘গুগল সায়েন্স ফেয়ার’ তার নজরে পড়ে। প্রতিবছর ১৩-১৬ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিজ্ঞান গবেষণাভিত্তিক এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে গুগল। যেখানে প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজ শুরু হয় অনলাইনে। আর সর্বশেষ পর্ব আয়োজিত হয় গুগলের সদর দপ্তরে। এবারও অনিলার পরামর্শে গুগল সায়েন্স ফেয়ারে নিজের কাজ জমা দেয় সালিহা। পরিবেশবান্ধব এই স্যানিটারি ন্যাপকিনের নাম দেয় ‘শ্রেষ্ঠ’। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রতিযোগিতার কথা নাকি সে ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎ একদিন ই-মেইলে জানতে পারে, প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। তারপর শুরু হয় অনলাইনে ছোট ছোট সাক্ষাৎকার আর তথ্য যাচাই-বাছাই পর্ব। ২০১৬ সালে গুগল সায়েন্স ফেয়ারের একটি নতুন পুরস্কার ‘কমিউনিটি ইমপ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড’ চালু করা হয়। নতুন এই ক্যাটাগরিতে সেরাদের মধ্যে জায়গা পায় সালিহা, পা রাখে গুগল সদর দপ্তরে। সেখানে গোটা পৃথিবীর বাছাইকৃত সেরা খুদে উদ্ভাবকেরা একত্র হয় তাদের কাজ নিয়ে। সামনাসামনি সাক্ষাৎকার আর গবেষণা নিয়ে কথা হয় বিচারকদের সঙ্গে। সবশেষে সেরা ১৬টি প্রকল্পে জায়গা করে নেয় সালিহার পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি ন্যাপকিন।
নিজের উদ্ভাবন প্রসঙ্গে সালিহা বলে, ‘শুধু প্রয়োজনীয় স্যানিটারি সুবিধার অভাবে অনেক মেয়েশিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে নারীদের একটা বিশাল অংশ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের কারও কারও সামর্থ্যও নেই আধুনিক স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার। তাই আমি আমার কাজের মাধ্যমে তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি।’
নারীর শরীরের এই স্বাভাবিক পরিবর্তন নিয়ে কেন কেউ কথা বলতে চায় না, এটাও তাকে ভাবায়। সালিহা রেহানাজ বলে, ‘আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন অনিলা ছাড়া তেমন কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। এটা যেন একটা “সোশ্যাল ট্যাবু”।’
পরিবেশবান্ধব এই স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির কাজ সালিহা ঘরে বসেই করেছে। ব্যবহার করেছে সহজলভ্য কিছু উপকরণ। এখন সে থাইল্যান্ডে ব্যাকালোরিয়েটে ডিপ্লোমা করছে। এরই মধ্যে সে তার বোন অনিলার নামে একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। যেখানে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হবে বিনা মূল্যে। এ ছাড়া ‘শ্রেষ্ঠ’ স্যানিটারি ন্যাপকিন বানিয়ে নারীরা তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে করে সে। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘হাইড্রোফোনিক সিস্টেম’ নিয়ে চলছে তার গবেষণা। পানিতে বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে নানা রকম সবজি আর ফলমূল উৎপাদন করছে সালিহা। সেসব বিক্রি করে সে হ্যাভেন্স চিলড্রেন হোমস নামে একটি শিশু আশ্রমের জন্য কাজ করছে।
সালিহা স্বপ্ন দেখে নারীদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসচেতন এক পৃথিবীর। যেখানে সমাজের মানুষ মাসিক নিয়ে আর নারীকে উপহাস করবে না। বরং সবার সাহায্যে নারীরা এগিয়ে যাবে বহুদূর। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সালিহার বক্তব্য, ‘আমি সব সময় ফলাফল চিন্তা করে কাজ করি না। যখন যেটা ভালোবাসি, সেটাই করি। হয়তো ভবিষ্যতে এটা আমার ক্যারিয়ারে কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে বহুগুণে। এমন কাজই হয়তো আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।’