ছয় তরুণের ‘বিজয় স্কুল’
- লিডারশিপ ডেস্ক
মুন্নি, তানিয়া ও রনি। আগারগাঁও বস্তির পরিবেশে বেড়ে ওঠা ওদের। যেখানে নেই শিক্ষার এক ফোঁটা আলো। জন্মের পর ক্ষুধা আর দরিদ্রতার সাথে জীবন-মরণ লড়াই। স্কুল বা পড়াশোনার পরিবেশের সাথে সম্পর্ক নেই পরিবারের কারোরই। মুন্নির বাবা আবুল কাসেম রিকশা চালান, মা মমতাজ বেগম বাসায় কাজ করেন। ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাবে, সহপাঠীদের সাথে ক্লাস, খেলাধুলা করবে এমনটি হয়তো কখনো ভাবেনি ওদের পরিবারের অভিভাবকরাও।
তবে ওরা এখন স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী। কাঁধে থাকে ব্যাগ ভর্তি বই। আগারগাঁও সুইপার কলোনি বস্তির এ রকম ৭০ শিশুর জীবন পাল্টে দিয়েছে বিজয় স্কুল। এদের কেউ ছিল টোকাই, কেউ ছিল নেশায় আসক্ত। ছয় তরুণের উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিজয় স্কুল পাল্টে দিয়েছে এ সব শিশুর জীবন। নেশা দ্রব্যের পরিবর্তে ওদের হাতে এখন শিক্ষা সামগ্রী।
বিজয় স্কুলের শুরুটা ২০১৩ সালে। তিন বন্ধু ফেরদৌস হাসান, মো. রফিকুল ইসলাম এবং রাজিব হোসেন। সবাই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। ব্লাড গ্রুপিং এবং ওষুধ সরবরাহের জন্য একদিন আগারগাঁও বস্তিতে যান। বস্তির ছোট ছোট বাচ্চাদের করুণ অবস্থা দেখে ওই দিনই একটা ভূত চেপে বসে তিন বন্ধুর মাথায়। যে করেই হোক এ সব বাচ্চাদের বস্তির পরিবেশের বাইরে একটা স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য মৌলিক শিক্ষার পাশাপাশি দিতে হবে নৈতিক শিক্ষা। তাদের সাথে যোগ দেয় আরো তিন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ মশিউর রহমান, এহসানুল মুন্তাকিম ও মাহমুদা আক্তার।
তবে যাত্রাটা শুরু হয় একটু ভিন্নভাবে। বিজয় স্কুলের স্বেচ্ছাসেবী দলের প্রধান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বস্তির পাশে একটা জায়গা ভাড়া করে কার্যক্রম শুরু করি। বিনোদনমূলক নানা কার্যক্রম এবং প্রতিদিনের খাবার দিয়ে বাচ্চাদের পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। পাশাপাশি ঘরে ঘরে গিয়ে অভিভাবকদের বোঝানো হয়। দিন দিন বাচ্চাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বস্তি ভেঙে দেয়ার কারণে স্থান পরিবর্তন করতে হয়। এরপর বস্তিবাসীর সহযোগিতায় পঙ্গু হাসপাতাল সংলগ্ন একটি খোলা জায়গায় নিজেদের খরচে ঘর তুলে আবার শুরু করি বিজয় স্কুলের যাত্রা। এখন আমাদের স্কুলে ৭০ জন শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে।
এই তরুণ আরো বলেন, দুই সিফটে ভাগ করে ক্লাস নেয়া হয়। সকালে ৪০ জন, বিকালে ৩০ জন। সকালে বাচ্চারা আমাদের স্কুল আঙিনায় ব্রাশ করে। তারপর নাস্তা সেরে ক্লাস শুরু করে। মৌলিক শিক্ষার পাশপাশি এ সব বাচ্চাদের দেয়া হয় নৈতিক শিক্ষা। ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝানো হয়। সবগুলো কাজই করা হয় বিনোদনের মাধ্যমে। ফলে বাচ্চারা ক্লাসে খুব মনযোগী হয়ে ওঠে। বাচ্চাদের ক্লাস নিতে ব্যবহার করা হয় মাল্টিমিডিয়া। প্রযুক্তির সহায়তায় বাচ্চাদের নৈতিক শিক্ষার নানা বিনোদনমূলক ভিডিও চিত্র দেখানো হয়। ফলে তারা খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলে।
মৌলিক শিক্ষা দেয়ার পর অনেক শিক্ষার্থীকে আশপাশ এলাকার প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ভর্তি করানো হয়। পরিবারের অভিভাবকরা রাজি না থাকলেও তাদের বুঝিয়ে রাজি করানো হয়। স্কুল পড়ুয়া এ সব শিক্ষার্থীদের বিকালে বিজয় স্কুলে কোচিং করানো হয়। পাশাপাশি শেখানো হয় নানা হস্তশিল্পের কাজ। যাতে এ সব শিক্ষার্থীরা নিজেরা কিছু করে চলতে পারেন।
আরেক স্বেচ্ছাসেবী মশিউর রহমান বলেন, আমরা যারা স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করছি, তারা সবাই শিক্ষার্থী। আমাদের নিজেদের ক্লাস শেষ করে বিজয় স্কুলের ক্লাস নেই। আর একজন স্বেচ্ছাসেবী স্থায়ীভাবে কাজ করেন। ৪ বছরে আমরা অনেকটা সফল। আগে বস্তির অধিকাংশ বাবা-মা তার সন্তানকে পড়ালেখা শেখাতে চাইতেন না। তবে এখন তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ৪’শ জনের উপরে স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। সকলের মাসিক চাঁদা দিয়েই বিজয় স্কুলের কার্যক্রম চালানো হয়।
শিক্ষার্থীদের মাঝে দেয়া হয় শিক্ষা সামগ্রী। সপ্তাহে একদিন শিক্ষার্থীদের খাওয়ানো হয়। স্বেচ্ছাসেবী হাসান ফেরদৌস বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের মাঝে শিক্ষার আলো দিয়ে বস্তির ভয়ার্ত পরিবেশ থেকে বের করে নিয়ে আশা। বস্তির পরিবেশের বাইরে একটা সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন গড়তে পারে সেজন্য শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা। বর্তমানে আমরা ৭০ জন বাচ্চার জন্য নতুন কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। যদি কোনো সচেতন নাগরিক একটা বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায় তা হলে বস্তিতেও আলো ফিরে আসবে।