ভারতের পথশিশুদের পাশে এক বাংলাদেশি
- লিডারশিপ ডেস্ক
বাংলাদেশের জি এম আবু তাহের পড়েন ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবসরে গরিব মেয়েদের বিনা পয়সায় পড়ান। তাঁকে নিয়ে ফিচার করেছে ‘জাগরণ’ ও ‘টাইমস অব আলীগড়’।
তখন তিনি চট্টগ্রামের আইআইটির (ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি) ছাত্র। তাহেরের লেখাপড়ার বিষয় ছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। লেখাপড়ার পাশাপাশি ম্যাগাজিনের পোকা ছিলেন। সময় পেলে ওয়েবসাইটেও ঢুঁ মারতেন। এভাবেই আলীগড়ের সঙ্গে পরিচয়। জানলেন, এটি ১৮৭৫ সালে উত্তর প্রদেশে মহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিল ১৯২০ সালে। সেখানে বিদেশের শিক্ষার্থীরা কম খরচে লেখাপড়া করতে পারে। তারপর থেকেই এই ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পাসে পড়ার ইচ্ছা। ২০১৫ সালে সেখানে চলেও গেলেন। এখন মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছেন।
প্রথম গিয়েই চমকে গিয়েছিলেন। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল আফতাব হলের মরিসন কোটের ৪৮ নম্বর রুম। রুমমেটদের মুখে শুনলেন, ব্রিটিশ আমলে এই জায়গাটি ছিল ঘোড়ার আস্তাবল! বইয়ে পড়া ক্যাম্পাসের চেয়ে এটি অনেক সুন্দর।
ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সেবামূলক কাজকর্মও কম-বেশি করতেন। বিদেশ-বিভূঁইয়েও সেটি মরেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া শুরু করলেন। দেশি-বিদেশি সহপাঠী ও বড় ভাইদের সঙ্গে পরিচয় হলো। তাঁরাও জানতে পারলেন—ছেলেটি মানুষের সেবা করতে চায়। গুজরাটের এক সিনিয়র ছাত্র পাত্র জুম্ফি শেঠ খুবই উৎসাহ দিলেন। এরই মধ্যে জানলেন, ‘উদ্যান সোসাইটি’ নামে আলীগড়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি সংগঠন আছে। এটি উত্তর প্রদেশ ও ছত্তিশগড় প্রদেশে ইউনিসেফের ছায়া সংগঠন হিসেবে কাজ করে। তাদের কাছে গেলেন। তখনো ভালোভাবে হিন্দি শেখা হয়নি। ইংরেজিতেই বললেন, আলীগড়ের আশপাশের গরিব শিশুদের বিনা পয়সায় ইংরেজি শেখাতে চান। তাঁকে বলা হলো, ক্যাম্পাসের পাশেই মেয়েদের সরকারি স্কুল আছে। সেখানে ওরা এইট পর্যন্ত পড়ে। তবে একজন মাত্র শিক্ষক থাকায় তারা ভালোভাবে লেখাপড়া শিখতে পারছে না। সে স্কুলে কাজ করার সুযোগ আছে।
ভর্তির কয়েক মাসের মধ্যে কাজে নেমে পড়লেন তিনি। প্রতিদিন সকালে হোস্টেলে নাশতা সেরে স্কুলে চলে যান। গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ইংরেজি শেখান। তাঁর স্কুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের দুদপুর, পুরান চুঙ্গি ও জামালপুর এলাকার শিশু-কিশোরীরা লেখাপড়া করে। সকালে ৯টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে নিজের লেখাপড়া করেন। দুপুরে ক্লাস সেরে আবার টানা বিকেল পর্যন্ত ক্লাস নেন। তাদের হিন্দিতে অন্যান্য বিষয়ও দেখিয়ে দেন তিনি। এভাবে নিজের হিন্দি চর্চা বাড়ান। সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিন ক্লাস নেন। বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা নেন না। চলাফেরা করেন নিজের সাইকেলে। এক বছর দুই মাস ধরে এভাবে স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন জিএম আবু তাহের। সেই গল্প করতে করতে তাহের হেসে ফেললেন, ‘কখনো ক্লাসে কথা বলতে বলতে আমি বাংলায় বলে ফেলি। আমার ছাত্রীরা অবাক হয়ে যায়। অনেকে জিজ্ঞেস করে, স্যার, কী বললেন? সেটির অর্থ বলি। আমি তো হিন্দিতে কাঁচা—ওরা কোনো কিছু বললে জানতে চাই। হাসতে হাসতে শেখায়। ওদের মা-বাবাও আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘স্যার, বিদেশ থেকে এসে আমার মেয়েকে আপনি পড়ালেখা শেখাচ্ছেন, এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’
তাহেরের এই কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০-১২ জন বিদেশি ছাত্রও এখন বঞ্চিত শিশুদের পড়াচ্ছেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে আরো ১০টি স্কুলে শিশুদের ইংরেজিসহ তাদের পাঠ্য বইগুলো পড়ান তাঁরা। এ ছাড়া তাদের বিভিন্ন সরকারি স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ফ্রি ভর্তি কোচিংও করানো হয়।
বাংলাদেশের এক ছাত্রের এই মহতী উদ্যোগের কথা ছড়িয়ে গেছে পুরো ভারতে। সে দেশের হিন্দি ভাষার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পত্রিকা জাগরণে তাঁকে নিয়ে ফিচার ছাপা হয়েছে। শিরোনাম ছিল—‘অশিক্ষা দূর করে শিক্ষার আলো জ্বালাচ্ছেন বাংলাদেশি তাহের।’ সেখানে তিনি ও তাঁর বন্ধু জামিল মিলে ভারতের অসহায়, গরিব শিশু-কিশোরীদের যেভাবে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, সেই গল্পটি তুলে ধরা হয়। ইংরেজি দৈনিক দ্য টাইমস অব আলীগড়ও ‘এডুকেটিং দ্য ইয়ং’ নামে তাঁকে নিয়ে ফিচার করেছে। তাতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে লেখাপড়ার হাল কী সেটিও বলা হয়েছে। ফলে ক্যাম্পাসের সবাই এখন তাহেরকে চেনে। এই নিয়ে বলতে গিয়ে তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল, ‘কোনো কোচিংয়ে পড়ালে হয়তো ১৫-২০ হাজার টাকা পেতাম। কিন্তু তাতে তো তৃপ্তি বা ভালোবাসা নেই। আমি আসলে কোনো ফলাফলের আশা করিনি। এসব কাজ করতে আমার ভালো লাগে। ভালোবাসা থেকেই শিশুদের পড়াই।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমি এই কাজের জন্য এতটাই বিখ্যাত হয়েছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করা হয়। আমার দেশের প্রতিও ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে আলাদা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে।’ বিভাগের শিক্ষক এ আর কিদওয়াই তাঁর এই কার্যক্রমের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ও তাঁর বন্ধুদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট প্রদান করেছেন। এ ছাড়া সামিনা খাতুন ও রেজওয়ান খান নামের দুই অধ্যাপক নিয়মিত তাঁদের অনুপ্রেরণা জোগান।