শিশু-কিশোরদের ‘টেক ল্যাব’
- বিজ্ঞান প্রযুক্তি ডেস্ক
‘দুর্বার’ একটি রোবটের নাম। রোবটটি ঠিক মানুষের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। বাসা কিংবা অফিসে সব কাজে মানুষের সহযোগী হবে। কথা বলবে, কথা বুঝবে। চেহারা চিহ্নিত করবে। সকালে ঘুম থেকে ডেকে দেওয়ার কাজটিও করবে রোবটটি। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রোবটটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দেশেই চলছে এমন একটি রোবট তৈরির কাজ। রোবট তৈরির কাজ করছে একদল শিশু। বয়স ৮-১৪। তাদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট, বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান ও শিক্ষা দিচ্ছে ‘টেক ল্যাব’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান।
কম্পিউটারের একটি প্রোগ্রামের কোডের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিল নূর (১৩) ও সায়ন (১৪)। বার বার সমাধানের চেষ্টা করছিল তারা, ব্যর্থও হচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য করছিলেন একজন শিক্ষক। শেষ অবধি শিশু দুটি পারল।
রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে ‘দ্য টেক ল্যাব’ নামক প্রতিষ্ঠানটিতে এভাবেই প্রযুক্তির নিত্যনতুন খেলায় মেতে ওঠে শিশুরা। আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। এখানে শিশুদের প্রযুক্তিতে হাতেখড়ি হয়। তারা শেখে কিভাবে সার্কিট ও প্রোগ্রামিংয়ের কাজ করতে হয়। শেখে গেম ও অ্যাপ তৈরির নানা কলাকৌশল।
শুধু শেখাতেই শেষ নয়, এরপর চলে নিজেদের উদ্ভাবন। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে কম্পিউটার গেম থেকে রোবট পর্যন্ত তৈরি করেছে। সেই রোবট হাঁটেও বেশ। এ পর্যন্ত শিশুরা ১২টা গেম তৈরি করেছে। গেমগুলো একটু ভিন্ন ধরনের। মোবাইল বা কম্পিউটারে খেলার পাশাপাশি শিশুরা নানা কিছু শিখতেও পারবে।
‘দ্য টেক ল্যাব’ হাতে কলমে বিজ্ঞান শেখার একটি ভিন্নধর্মী পাঠাগার। যেখানে শিশুরা ইচ্ছামতো বিজ্ঞানের যে কোনো বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করে। নিজেরাই সমস্যা খুঁজে বের করে এবং সমাধানেরও চেষ্টা করে। এখানে রোবট তৈরির প্রজেক্টে কাজ করছে পাঁচ শিশু। নাম নূসরাত, শায়ন, নূর, মিকাইল ও নাহিয়ান। এরা সবাই রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে নূরের পুরো নাম আবু নাফিস মো. নূর। বয়স ১৩। বনানী বিদ্যানিকেতনে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। টেক ল্যাবে এক বছরের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম শেষ করে এখন সেখানেই শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছে। নতুন শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের নানা দিক।
রোবট তৈরির কাজ এখন তৃতীয় ধাপে আছে। ইতোমধ্যে দুর্বার মোবাইল অ্যাপ তৈরির কাজ শেষ। অ্যাপ ব্যবহার করে মোবাইল দিয়ে রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ভয়েজ কন্ট্রোল করা যাবে। কমান্ড অনুযায়ী কাজ করবে, জানালো শিশুরা।
১৪ বছরের সায়ন একাই কাজ করছে অন্য একটি প্রজেক্ট নিয়ে। নাম ‘ব্রেইন ওয়েভ ডিটেক্টর’, যা মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ চিহ্নিত করতে পারে, এমন একটি বিশেষ যন্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। এটি ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন তরঙ্গের রেখাচিত্র আঁকা যাবে কম্পিউটারে! সাই-ফাই চলচ্চিত্রের কল্যাণে এসব যন্ত্রের ব্যবহার তো কতই দেখা গেছে। এবার এ দেশের শিশু প্রযুক্তিবিদদের তা করে দেখানোর পালা। ধরুন, আপনি আপনার রুমের লাইট বন্ধ করতে চান। এমন ভাবনা আপনার মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে লাইটটি বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিবন্ধী শিশুরা এটি ব্যবহার করে সব ধরনের কাজ সম্পন্ন করতে পারবে।
টেক ল্যাবে আসার জন্য মায়ের সঙ্গে চুক্তিতে এসেছে সায়ন! এমনিতে দুপুরে পড়তে বসা হয় না কখনো। কিন্তু টেক ল্যাবে আসার জন্য পরীক্ষার পড়া দুপুরেই শেষ করতে রাজি হয়েছে সে। কারণ, বিকেলে যে টেক ল্যাবে আসতে হবে! মা সামিনা সুলতানা জানান, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে এখানে আসি। এখানে সমবয়সী অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশ আনন্দে থাকে সায়ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি তার আগ্রহ অনেক। টেক ল্যাবে আসার পর একটি রোবটও বানিয়েছে সে।
অন্যদিকে আরেকটি প্রকল্পে নূর (১৩) ও শায়ন (১৪) একসাথে তৈরি করেছে ‘অগ্নি দুর্ঘটনা নিবারক’ মোবাইল অ্যাপ। অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল দিয়ে একটি বাটন চাপলে অগ্নি দুর্ঘটনার তথ্য চলে যাবে নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পুলিশ স্টেশনে। অন্ধ মানুষের চলাফেরার সুবিধার জন্য শিশুরা তৈরি করেছে ‘ব্যাপম্যান গ্যাজেট’ নামক একটি প্রযুক্তি। যা ব্যবহার করে একজন অন্ধ মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন। চলার পথে সামনে কোনো বস্তু থাকলে তা চিহ্নিত করতে পারবেন। এমনকি বস্তুটি কতো দূরত্বে আছে, বস্তুটির আকার, আকৃতি এবং রং সবকিছুই তিনি বুঝতে পারবেন।
টেক ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা নিলয় অনিক। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির তড়িত্ ও যন্ত্র প্রকৌশলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে একটি স্কুল-পরবর্তী প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করেন। তাতেও ব্যর্থ হয়ে শিশুদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের একটি স্কুল তৈরির উদ্যোগ নেন। সেখানে রোবোটিকস, কম্পিউটার সায়েন্স, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে পড়ানো হতো। উদ্যোগটি একসময় থেমে যায়। তবুও দমে যাননি এই তরুণ।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয় টেক ল্যাব প্রতিষ্ঠার কাজ। এখন মোট ৩০ জন শিক্ষার্থী আছে এখানে। শিক্ষক আছেন তিনজন। বিভিন্ন স্কুলে ওয়ার্কশপ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রযুক্তির আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য টেক ল্যাবের স্বপ্ন অনেক বড়। এ দেশের প্রতিটি শিশু শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি, যাতে সবাই প্রযুক্তির উদ্ভাবনে অবদান রাখতে পারে।
নিলয় অনিক বলেন, এখন বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের এখানে নিয়ে আসছেন। আমরা চাই শিশুরা প্রযুক্তি-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো নিজেরাই সমাধান করুক। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
টেক ল্যাবে শিশুদের জন্য এক বছরের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম আছে। এতে আছে মোট তিনটি লেভেল। প্রথম লেভেল চলে দুই মাস। এতে সার্কিট ও প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করে শিশুরা। এর পরের চার মাস চলে দ্বিতীয় লেভেল। তাতে গেম ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করা হয়। আর শেষ ছয় মাসে বাস্তব জীবনের কোনো সমস্যার সমাধান সম্পর্কে নিজেদের ভাবনা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শিশুরা। এ থেকেই তৈরি হয় গেম, রোবট প্রভৃতি।