সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অসম্ভব নয়
- ড. মীজানুর রহমান
প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রাক্কালে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি আলোচনায় আসে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এবারও অনেকে আগ্রহী ছিলেন। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের মতো ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে সহজে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার প্রবর্তন করা যেতে পারে। তবে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামতই উঠে আসে। প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অসম্ভব কিছুই নয়। আর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার মানেরও কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না। এবারও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হচ্ছে না। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মতি আছে। বর্তমানে আউটপুটের দিক থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রানার-আপ।
আরো ভালো করার চেষ্টা করছে। গত দুটি বিসিএস ও জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সেশনজট প্রায় নেই বললেই চলে। গত পাঁচ বছরে তিন দিনের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হয়নি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স অনেক কম। তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক থেকে বড়। এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই হাজার ৯০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ৭৫টি আসন সংরক্ষিত থাকবে।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে শুধু একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। কারণ ইঞ্জিনিয়ানিং, মেডিক্যাল, টেক্সটাইল, কৃষি, বেসরকারিসহ বিভিন্ন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যে বিভিন্ন ইউনিটব্যবস্থা প্রবর্তন করেছি, যেমন—বিজ্ঞান অনুষদের জন্য ‘এ’ ইউনিট, কলা অনুষদের জন্য ‘বি’, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের জন্য ‘সি’ ইউনিট ইত্যাদি। এটা এমন হবে যে সংগতিপূর্ণ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা একই দিন একই প্রশ্নে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। যেমন—ঢাকার পরীক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবে। তদ্রূপ চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেটের শিক্ষার্থীরা সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। অর্থাৎ সব পরীক্ষার্থীই নিকটস্থ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তার অপশন থাকবে। মেধা অনুযায়ী ওই পরীক্ষার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে, সেখানেই ভর্তি হবে। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র পরীক্ষা দেবে, সে খুব মেধাবী হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে জগন্নাথে না টিকলেও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে। অর্থাৎ স্বতন্ত্র ইউনিটব্যবস্থার অধীনে ভর্তি পরীক্ষা হবে সারা দেশে, তেমনি মেধা অনুযায়ী ইউনিটভুক্ত বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তির সুযোগ থাকবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্পূর্ণ মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার মতো। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কয়েকবার ক্যাম্পাসে আসতে হতো। যেমন—ফরম তোলা, প্রবেশপত্র সংগ্রহ এবং সর্বশেষ ভর্তি পরীক্ষা। এখন দুর্ভোগ মোচন করেছে অনলাইন। ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক বিষয়টি প্রধান বিবেচ্য নয়। কারণ একজনের টাকা ব্যয় মানেই অন্যজনের টাকা আয়। ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা টাকা ব্যয় করে ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট যাচ্ছে। এতে গাড়ির মালিক, ড্রাইভার, রিকশাচালকরা উপকৃত হচ্ছেন। অর্থাৎ জিডিপিতে কিছুটা হলেও অবদান থাকছে। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি, দুর্ভোগ তথা কষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনার বিষয়। ঢাকায় শিক্ষার্থীরা আত্মীয়স্বজন, হোটেল, মেসে অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে থাকতে পারে। কারণ বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানকার মানুষ ঢাকায় থাকে না। কিন্তু রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রামে থাকার ব্যবস্থা সীমিত। এতে হয়রানি বেড়ে যায়। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ক্রমান্বয়ে স্বচ্ছ ও সঠিক হলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষারও কোনো প্রয়োজন হবে না। কেননা আগে অনেকে বলত, পরীক্ষার খাতায় খুব বেশি মার্কস দেওয়া হয়েছে। খাতা যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। যখন এসব বিতর্ক ও প্রশ্নগুলো দূর করা সম্ভব হবে তখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষারই দরকার হবে না। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে চারটি পাবলিক পরীক্ষার সনদধারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আসবে। কাজেই তারা যে জিপিএ পেয়েছে, তা শিক্ষা বোর্ড থেকে দেওয়া। পূর্ববর্তী পরীক্ষার মেধা স্কোর অনুসারে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাবে। ফলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোয় এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ওই বিষয় বিবেচনা করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা সম্ভব।
তবে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়েছে। কারণ যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে, তারা আবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। এতে শিক্ষার্থীরা এক দিনে ঢাকাকেন্দ্রিক দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে সক্ষম হবে। ফলে কিছুটা হলেও ভোগান্তি লাঘব হবে। বিভিন্ন সময়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগ একেবারে নেই বললে চলে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব রটে। যার জন্য মূলত অভিভাবকরাই দায়ী। কারণ অভিভাবকরা যদি রাত জেগে ফেসবুকে প্রশ্নপত্র খোঁজেন, তাহলে তো গুজব রটবেই। আর একটি বিষয়, দেশে এত উচ্চশিক্ষিত মানুষের দরকার আছে কি? বেকারত্বের সর্বশেষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যারা উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা করেনি, তাদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ৭ শতাংশ, স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকার প্রায় ১৭ শতাংশ। কাজেই আমাদের অনেক কিছুই ভাবতে হবে। শত চেষ্টা করেও যেসব মেধাবী ছাত্র উচ্চশিক্ষা নিতে চাইবে, তাদের জন্য রাতারাতি ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারব না। একমাত্র কারিগরি শিক্ষাই হতে পারে বেকার সমস্যা সমাধানের বিকল্প। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রচুরসংখ্যক কারিগরি ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা জাতির অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়