ভাকুর্তার প্রাচীন গয়নাকারিগরদের কথা
- ফাতেমা আক্তার মহুয়া
নারীর সৌন্দর্য বাড়াতে অলংকারের জুড়ি নেই। অলংকারের প্রতি নারীর ভালবাসার সম্পর্কটা হাজার বছরের। শুধু নারীরাই কেন আগের দিনের রাজা বাদশাহরাও তো নিজেদের সামাজিক অবস্থান বুঝাতে নিজেকে সজ্জিত করতেন নানা অলংকার যেমন মতির মালা, মুল্যবান পাথরের আংটি বা কুর্তিতে লাগাতেন স্বর্ণের বোতাম। সময়ের বিবর্তনে সেইসব অলংকার ও তার উপাদান আর ব্যবহারেও এসেছে পার্থক্য। এইসব তো আমরা সবাই জানি। শুধু অজানা রয়ে গেছে সেইসব স্বর্ণ কারিগরদের কথা।
ঢাকার বিভিন্ন অলংকারের দোকানে বা অনলাইনে হরহামেশাই আমরা নানাধরনের অলংকার দেখে থাকি কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা এইসব অলংকার ঢাকার অদূরেই সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নে তৈরি হয়। ধারনা করা হয় কুমিল্লার গহনা তৈরির গ্রাম ভাকুর্তাকে অনুসরণ করেই এই গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ভাকুর্তা। বিক্রেতার হাতে পৌঁছানোর পূর্বের ৯৫ ভাগ কাজই সম্পন্ন করেন এই গ্রামের কারিগররা। ৩৬টি গ্রামের ভাকুর্তার প্রায় প্রতিটা পরিবারই অলংকার তৈরির সঙ্গে জড়িত। আড়াই হাজারেরও বেশি পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে এই ব্যবসায় থেকে। ভাকুর্তার বটতলা, সোলাই মার্কেটসহ বিভিন্ন বাজারে সবমিলিয়ে প্রায় আট শতাধিক অলংকার তৈরির দোকান রয়েছে।
তবে ভাকুর্তার কারিগরদের ইতিহাসটা বেশ পুরনো। প্রায় ৩০০ বছর ধরে ভাকুর্তার জনপদ গহনা তৈরি করে আসছে। বাংলার নবাবী আমলের শেষ দিকে ও ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে অনেক কারিগরই প্রাণভয়ে কলকাতা থেকে বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। এরপর বেশখানিকটা সময় পার হয়। একটা সময় ব্রিটিশ শাসনও শেষ হয়। বাংলাদেশের উৎপত্তি হয়। ১৯৮০ সালের দিকে কারিগররা স্থায়ীভাবেই তাঁতিবাজারে অলংকার তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে স্বর্ণের চাহিদা পড়ে যাওয়ায় লোকসানে পড়তে হয়। অতঃপর রূপা দিয়েই চলতে থাকে কাজ। কিন্তু বিধিবাম। ২০১০ সালে রূপার ব্যবসাতেও ভাটা পড়লে বাধ্য হয়েই কপার ধাতু দিয়ে অলংকার তৈরি শুরু করেন। কেননা এই একটি কাজেই তারা পারদর্শী। উপরন্তু কপার সহজলভ্য ও স্বল্পমূল্য়েই কেনা যায়। গহনা তৈরির বেশকিছু কাঁচামাল ভারত থেকে আসে। এছাড়া কুমিল্লার ভাকুর্তা গ্রাম থেকে চুড়ির বেস, তাঁতিবাজার ও বাবুবাজার থেকে ছোট ছোট কাঁচামাল এনে গ্রাহকের মনমতো নকশা বানিয়ে স্বর্ণ বা রূপার রঙে গড়িয়ে নিলেই কাজ শেষ। ভাকুর্তার দোকানগুলোতে দেখা মেলে হাজারো ধরনের গহনা। গলার হার, নাকের নোলক, মুকুট, চুড়ি-বালা, শিতাহার, আংটি, পায়ের নূপুর কি নেই ভাকুর্তা বাজারে। আবার দাম কম হওয়াতে এইসব অলংকারের চাহিদাও দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে ব্যবসায়ীরা পুরোপুরিভাবে স্বর্ণালংকার তৈরি বাদ দেননি। প্রায় ৭০ শতাংশ অলংকার কপার দিয়ে তৈরি হলেও বাকি গহনাগুলো তৈরি হয় স্বর্ণ ও রূপা দিয়ে।
ভাকুর্তার বাজারগুলো থেকে পাইকারি বা খুচরা দুইভাবেই গহনা কেনা যায়। তবে সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানালেন সাধারণত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মার্কেটগুলো থেকে তারা ৩ থেকে ৭ লাখ টাকার অর্ডার পেয়ে থাকেন। এছাড়াএশিয়া, মিডল ইস্টসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তারা অর্ডার নিয়ে থাকে। নিউমার্কেট, মগবাজার, কৃষি মার্কেট, ধানমণ্ডির মেট্রো শপিং মল, রাপা প্লাজাসহ নগরীর ছোট বড় সব মার্কেটের গহনা তৈরির কাজগুলো করেন এই গ্রামের কারিগররাই।
শুরুর দিকে হিন্দু কারিগররাই একচেটিয়া ভাবে ভাকুর্তার অলংকার বাজার চালিয়ে নিয়ে গেলেও এখন মুসলিম কারিগররাও এই ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বর্তমানে ভাকুর্তার প্রায় ৯৫ শতাংশ হিন্দু পরিবার এবং ৫০ শতাংশ মুসলিম পরিবার অলংকার তৈরির কাজ করে যাচ্ছে।
বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদ,পূজা-পার্বন, বৈশাখে ভাকুর্তার কারিগরদের ব্যস্ততা থাকে সবচেয়ে বেশি। তখন দম ফেলার ফুরসত নেই। দোকানে যেমন কারিগররা ব্যস্ত তেমনি বাড়ির আঙ্গিনাগুলোতেও মহিলা- কিশোরী এমনকি শিশুরাও ব্যস্ত গহনা তৈরিতে। কেউ গহনায় পাথর বসাচ্ছে আবার কেউ নূপুরের ঝুমকা লাগানোতে ব্যস্ত। অলংকার বানানোর ব্যস্ততার মধ্যেই প্রকাশিত হয় ভাকুর্তার আসল রূপ।
এসব কিছুর পরেও ব্যবসায়ীদের মনে রয়েছে আক্ষেপ। ভাকুর্তার যোগাযোগ দুরাবস্থা বর্ণনাতীত । নেই কোন ভালো পাকা রাস্তা , যাতায়াতের পথগুলো খানাখন্দতে ভরা। মাটির রাস্তা গুলো অল্প বৃষ্টিতেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। আবার গহনা তৈরির অনেক আধুনিক মেশিন নেই বাংলাদেশে ফলে কাঁচামালের জন্য এখনও নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের উপর। ব্যবসায়ীদের মতে যোগাযোগের দুরাবস্থার কারণে ভাকুর্তা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ঢাকা থেকে। আবার দেশের বাইরে তাদের গহনা রপ্তানি হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ভাকুর্তার গহনার বাজার আন্তর্জাতিক ভাবে পাচ্ছেনা পরিচয়। ফলে একটি সম্ভাবনাময় ব্যবসা রয়ে যাচ্ছে আড়ালে যা কিনা বেকারত্ব দূরীকরণে ও দেশের আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।