গুয়াংজুর সুখী মানুষেরা
- জহিরুল চৌধুরী
খুব ভোরে এসে পৌঁছলাম গুয়াংজুতে। ইমিগ্রেশনে তিন জন অফিসারের স্থলে কাজ করছিল মাত্র একজন। স্বাভাবিকভাবে সময় লাগছিল। প্রায় সবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল। অবশেষে ক্ষণস্থায়ী ভিসার সীল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিল। বিমান বন্দরের বাইরে যাবার অনুমতি পেলাম।
চায়না সাউথার্নের আয়োজনে থাকা এবং সকালের নাস্তা। বাকিটা নিজের খরচে। হোটেলের লবিতে পৌঁছে সামান্য আনুষ্ঠানিকতা সেরে তিন তলার একটি কক্ষে আশ্রয় নেওয়া। ঘুমের তাড়ায় তড়িঘড়ি নাস্তা সেরেছিলাম কলা, কমলা আর সামান্য ভেজিটেবলে।
প্রায় ১৫ ঘন্টার অবস্থানে পুরোটাই ঘুমিয়ে কাটাবো স্থির করলাম। কিন্তু ঘুমেরও তো আলস্য আছে! সকালের নাস্তা সেরে ঘুমোলাম একটানা তিনটা পর্যন্ত। দাঁত ব্রাশ আর শেভ করে ছুটলাম ডাইনিংয়ের উদ্দেশে। কিন্তু ডাইনিংয়ের আলো ততক্ষণে নিভে গেছে! মধ্যাহ্ন ভোজের সময় শেষ!
পেটটা চুঁ চুঁ করছে। কিছু একটা খাওয়া খুব জরুরি। নিদেন পক্ষে নুডলস স্যুপ। হোটেল থেকে বেডিয়ে হাঁটছি। আর লোকজনকে জিজ্ঞেস করছি আশেপাশে ব্যাংক কোথায়? আমার পকেটে মানিব্যাগে এক’শ ডলারের নোট। হোটেলের লবিতে পন্চাশ ডলার ভাঙতে চেয়েছিলাম। ওরা বলে- হয় পুরো এক’শ ভাঙতে হবে, নয়ত হবে না! দুর্ভাগ্যজনক নিয়ম!
হোটেলের পেছনে হাঁটা দূরত্বে বেশ কিছু ছোটখাটো রেস্তরা। কিন্তু কেউই এই এক’শ ডলারের বোঝা নিতে চায় না! এদিকে হাঁটার কারণে পেটের মধ্যে একপ্রকার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জানি না কতদূর হাটতে হয়!
হোটেলটি বিমানবন্দর থেকে ১৫ মিনিটের গাড়ি দূরত্বে। সমতল ভূমি। রাস্তার দু’পাশে অজস্র ফুলের বাহার। এক পাশে কৃষি খামার। খামারে আছে কলাগাছের সারি আর শীতের শাক-সব্জি। আমাদের দেশের দৃশ্যপট। একজন কৃষক ভিস্তি থেকে পানি ছিটিয়ে শুষ্কতা নিবারণ করছেন।
আরো কিছুদূর হেঁটে গেলাম। এবার বস্তি এলাকা। আবাসিক ভবনের অলিন্দে গাড়ি পার্ক করা। বিএমডব্লিউ, অউডি, মার্সিডিজ, নিশান, টয়োটা সব দেশের গাড়িই আছে, কেবল আমেরিকান ছাড়া। অথচ ইউরোপের রাস্তাঘাটে হামেশাই আমেরিকান গাড়ি দেখেছি।
কয়েকটি আবাসিক ভবনের ছায়ায় কয়েকজন বুড়োবুড়ি মিলে তাস খেলছে। এমন সুখী মানুষের সুখী পরিবেশ আমি আর কোথাও দেখিনি। আমেরিকায়ও বুড়োবুড়িরা একত্রে তাস খেলেন সিনিয়র সেন্টারে। খুবই আনুষ্ঠানিকতায়। গাড়ি করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়, আবার ফিরিয়ে আনা হয় প্রতিদিনের কার্যক্রম শেষে। অথবা কেউ কেউ স্থায়ীভাবে আশ্রয় নেন বৃদ্ধ নিবাসে।
চীনেও বৃদ্ধ নিবাস আছে। কুড়ি বছর আগে ১৯৯৯ সালে প্রথম যে বার চীনে আসি তখনই ট্রাভেল গাইড আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সে রকম একটি নিবাসে। তবে বেশিরভাগ চীনা বৃদ্ধবৃদ্ধা কয়েক প্রজন্মের সঙ্গে পরিবারে থাকতেই পছন্দ করে।
এরইমধ্যে আমি চার-পাঁচটি রেস্তঁরায় ঢুঁ মেরেছি খাবারের জন্য। তারা ডলার রাখতে রাজি। কিন্তু এক’শ ডলারের নোট দেখেই না করে দেয়। কেউই ইংরেজী বুঝে না। ইশারায় কথা বলা। এদিকে হেটে যাচ্ছিল দুই সুদানিজ। তারা ইংরেজীতে জানালো- খানিকটা দূরে আরব বস্তি এলাকায় গেলে তুমি যতখুশি ডলার ভাঙতে পারবে। কিন্তু এলাকাটি বেশ দূরে।
চীনাদের ইংরেজী জানার প্রয়োজন নেই। দোকানে সবই চীনা পত্রপত্রিকা। পিপলস ডেইলী নামের একটি ইংরেজী দৈনিক প্রকাশিত হয় বলে জানি। সেটিও আজ নজরে এলো না। প্রশ্ন জাগে- বহির্বিশ্বের সঙ্গে চীনারা কতোটা পরিচিত?
চীনে তাদের নিজস্ব এপ “উইচ্যাট” এতটাই জনপ্রিয় যে আজকাল সবাই রেস্তরায় খেয়ে অর্থ পরিশোধ করে এই এপটির মাধ্যমে। আমার ধারণা বিশ্ব জগত সম্পর্কে চীনারা জানে ঠিকই। তবে নিজেদের মত করে। আবার ভুলভাল জানার চেয়ে কম জানাও অনেক ভালো।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি বাজার এলাকায়। চারদিকে সারি সারি দোকান। একটি দোকানের সামনে এসে চোখ আটকে গেল। আয়ুশী- ইন্ডিয়ান রেস্তরা। পাশে আবার ইংরেজীতে লেখা ‘হালাল’। রেস্তরাটি একেবারে আন্ধার, অথচ সামনে বিশাল পর্দায় হিন্দি ছবির নাচ চলছিল।
নাচের ঝংকারে আমিও দুলে উঠেছি। দেখি একলোক চেয়ারগুলো একত্রিত করে ঘুমাচ্ছে। শোয়া থেকেই জানালো শেফ গেছে মধ্যাহ্ন বিরতিতে। ফিরবে বিকেল পাঁচটায়। এখনো ৩০-৪০ মিনিট বাকি। তবে সহজ কিছু হলে সে বানিয়ে দিতে পারে।
আমি সবচেয়ে দামী একটি খাবার বেছে নিলাম। যাতে দামী খদ্দের হাতছাড়া না করে ধড়ফর আমাকে বানিয়ে দেয়। অথচ খাবারটা তৈরি করাও সিম্পল হয়। আমি জানি- ইন্ডিয়ান রেস্তরায় আজকাল সবকিছু তৈরিই থাকে। কেবল কড়াইতে তেল পিয়াজ ঢেলে সেগুলো মিক্স করে নিলেই হয়।
খাবারটির নাম মাটন বিরিয়ানি। দাম ৫৮ চীনা ইউয়ান। ৮ ডলারের মতো। ২ ডলার টিপস সহ ১০! এবার দেশে যাবার সময় ক্রেডিট-ডেবিড কোনো কার্ডই নিয়ে যাইনি। নগদের উপর ভরসা রেখে নির্ঝন্জাট চলাচলের জন্য। একইভাবে ঋণমুক্ত, এবং সাধ্যের মধ্যে ব্যয় ধরে রাখাও ছিল উদ্দেশ্য।
আয়ুশী রেস্তরাঁর ম্যানেজার জগদীশ, উত্তর ভারতের। বয়স ৩০-এর কোঠায়। তবে খোঁচা খোঁচা দাড়িমোচ আর স্থুল বপুর অবয়বে বয়সটা একটু বেশিই মনে হয়। রেস্তরাটি কী করে হালাল হলো, সে প্রশ্ন করেছিলাম জগদীশকে। জানালো- এই রেস্তরায় বেশিরভাগ মুসলমানরাই খেতে আসে। তাই হালাল নামটি জুড়ে দেয়া। সব ধর্মের মানুষেরই হালাল খেতে অসুবিধে নেই, কেবল শিখরা ছাড়া। যদিও শিখ খদ্দের আসে ছয় মাসে একটি।
আমার মাটন বিরিয়ানি এলো। আমরা যেভাবে খেতে অভ্যস্থ, সে রকম নয় মোটেও। যে রকম ধারনা করেছিলাম, সে করমই। তেলে চাউলে মেশানো ছাগলের মাংসের কুচি। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। তাই গোগ্রাসে গিললাম।
এবার বিল পরিশোধের পালা। এক’শ ডলারের নোটটি এগিয়ে দিয়ে বললাম- সোজা দশ ডলার রেখে দাও। কিন্তু তার ক্যাশবাক্সে ফেরত দেয়ার মত ৯০ ডলার কেন, ৮০ ডলারও নেই! অগত্যা যুক্তরাষ্ট্র ফিরে ডাকে পাঠিয়ে দেব, এমন মনোবান্ছায় রেস্তরা থেকে হোটেলে ফিরলাম। বিল পরিশোধ করতে পারলাম না বলে তো খাবারটা আবার বমি করে ফিরিয়ে দিতে পারি না!
আমার এই ক্ষুধা নিবারণের অভিযানে একটি বিষয় আবিষ্কার করলাম- চীনারা ভারতীয়দের তুলনায় অনেক বেশি ব্যবসাবুদ্ধির। কিভাবে বিল পরিশোধ হবে, সেটা তারা আগেভাগে ফয়সালা করে নিতে চায়। এমন কি ৫ ডলারের নুডল স্যুপ হলেও। সে তুলনায় জগদীশের উদারতায় আমি মুগ্ধ। মনস্ত করেছি- তাকে দ্বীগুণ মূল্য পাঠাবো। আর চিঠিতে লিখবো- আমার মত কেউ ক্ষুধার্ত হয়ে তার রেস্তরায় গেলে যেন কখনো ফিরিয়ে না দেয়।