হাঁটুর ব্যথা কেন হয়
- ফাহমিদা শিকদার
হাঁটুর ব্যথা এমন একটি অসুখ, যা সব বয়সেই হতে পারে। হাঁটুর ব্যথার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হলো স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান এসকেএফ নিবেদিত ব্যথার সাতকাহন-এর দ্বিতীয় পর্বে।
ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ, যোগব্যায়াম বিশেষজ্ঞ আনিকা রাব্বানী এবং সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম। অনুষ্ঠানটি ২০ মার্চ প্রথম আলো ও এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাভেদ ওমর বেলিমের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁর খেলার সময় এবং এখনকার ফিটনেস রহস্য। তিনি বলেন, ‘আমার ক্যারিয়ারটি ছিল খুব স্ট্রাগলিং। আমি অত ট্যালেন্টেড ক্রিকেটার ছিলাম না। কিন্তু আমি কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাসী ছিলাম। নিজেকে প্রমাণের জন্য সব সময় ট্রেনিং বা জিমের বাইরে বাড়তি ব্যায়াম এবং ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করতাম, যেটা আমার ফিটনেসে বেশ কাজে দিয়েছে। আর এখন যদি ফিটনেসের দিকে খেয়াল না রাখি, তাহলে খুব আলসেমি লাগে। আমি আসলে ফুটবল খেলা, সাঁতারকাটা খুব উপভোগ করি। তাই এখনো টুকটাক কিছু না কিছু করি।’
ফিটনেসে সবচেয়ে বড় একটা ভূমিকা পালন করে খাদ্যাভ্যাস। এ নিয়ে জাভেদ ওমর বেলিম বলেন, ‘আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন ফিট থাকতে বা পেট কমাতে কী করবেন। আমি বলি, জিবকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আর যাঁরা প্রফেশনাল খেলোয়াড়, তাঁদের তো নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। পুরান ঢাকার ছেলে বলে বিরিয়ানি আর ভাতের প্রতি আমার টান অনেক। তবু খেলার সময় আমি অনেক কন্ট্রোল করতাম। আর এখন আগের মতো না হলেও আমি কার্বোহাইড্রেট কম খাই।’
ডায়েট নিয়ে আনিকা রাব্বানী বলেন, ‘২৫ বছর বয়সের পর থেকে আমাদের শরীরের মেটাবলিজম কমতে থাকে। তার মানে, আমাদের চর্বি পোড়ানোর ক্ষমতা কমে যায়। আমাদের ওজন বাড়তে থাকে। আমরা যদি অনেক খাই, তাহলে আমাদের কার্ডিও বা পাওয়ার ইয়োগা করতে হবে। কারণ, হার্ট রেট না বাড়লে অতিরিক্ত ক্যালরি পুড়বে না। কেউ যদি ভাত খেতে পছন্দ করেন, তাহলে তাঁরা সপ্তাহে দুই দিন আরামসে ভাত খেতে পারেন। বাকি দিনগুলো বেশ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে চলা উচিত, যদি আমরা কোনো ক্রনিক ডিজিজ না চাই।’
ইয়োগার সঙ্গে ফিট থাকার সম্পর্ক নিয়ে আনিকা রাব্বানী বলেন, ‘ইয়োগা হচ্ছে মন এবং শরীরের সংযোগের বিষয়। ইয়োগা মনের যত্ন নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। এর ভিত্তিটাই হলো শৃঙ্খলা।’ খাবারদাবার ও ঘুমের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বেশি রাত না জাগা, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা, এসব জিনিস যাঁরা ইয়োগা প্র্যাকটিস করেন, তাঁদের মেনে চলতে হয়। সপ্তাহে তিন দিন ইয়োগা করা উচিত। সম্ভব না হলে অন্তত এক দিন করতে হবে। এতে শরীরে মায়োফেশিয়াল রিলিজ হয়। এই রিলিজের ফলে অনেক ইনজুরি সেরে যায়, রক্তসঞ্চালন ভালো হয়।’
ক্রিকেটারদের হাঁটুর ব্যথা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় জাভেদ ওমর বেলিমের কাছে। তিনি বলেন, ‘খেলোয়াড়দের সহজে হাঁটু ব্যথা করে না। সারা দিন খেলার পর টিস্যু ড্যামেজ হয়, তখন আইসিং দিলে সেরে যায়। এর ভেতর মিনিকাস বা লিগামেন্টের ইনজুরি হলে ব্যথা হয়, অপারেশনের দরকার হয়। আর সাধারণ মানুষের ব্যথা হয় বয়স হলে হাড় ও লিগামেন্ট দুর্বল হলে বা অতিরিক্ত ওজন হলে। তাঁরা ব্যথা কমানোর জন্য সবার আগে ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ভালো টেকনিকের ফ্রি স্কোয়াট বা লাঞ্জেস করতে পারেন। সম্ভব হলে ফ্রি হ্যান্ড ওয়েট ট্রেনিং করলে ব্যথা কমে যাবে।’
হাঁটুর ব্যথা হলে আনিকা রাব্বানী হলুদ খাওয়ার পরামর্শ দেন। আর ব্যথা জায়গায় ক্যাস্টর অয়েল মেখে গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে সেঁক দেওয়ার কথা বলেন। এ ছাড়া তিনি বলেন, ‘আমাদের যে কোয়ারডিসেপ মাসল আছে, সেটি শক্ত থাকলে ব্যথা হয় না। এর জন্য খুব সামান্য কিছু ব্যায়াম, যেমন চেয়ারে বসে একসঙ্গে পা ওঠানো–নামানো করা যেতে পারে। এ ছাড়া লোয়ার ব্যাকস্ট্রোক বা ওয়েট ট্রেইন করলে হাঁটুর ব্যথা কম হয়।’
হাঁটুর ব্যথা কেন হয়, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ। তিনি বলেন, ‘হাঁটুতে বেশি চাপ পড়লে এর আশপাশের লিগামেন্টে বিভিন্ন ফর্মে ইনজুরি হতে পারে। এ জন্য ব্যথা হয়। এ ছাড়া ট্রমাটিক কারণেও ব্যথা হয়ে থাকে। আমি যেহেতু বাত বিশেষজ্ঞ, আমার কাছে বাতের রোগীরা হাঁটুব্যথা নিয়ে আসেন। বয়স্কদের অস্টিওআরথ্রাইটিস হলে ব্যথা হয়। ছোটদের রিউমাটয়েড জ্বরের জন্য ব্যথা হতে পারে।’ বাতের হাঁটুব্যথা আর সাধারণ হাঁটুব্যথার পার্থক্য আছে। বাতের হাঁটুব্যথায় ইনফ্ল্যামেশনের কিছু চিহ্ন ফুটে ওঠে। যেমন, হাঁটু লাল হয়ে যায়, ব্যথায় ফুলে যায়, যখন বিশ্রাম করা হয় তখন ব্যথা বেশি হয়। আবার আঘাতজনিত ব্যথা বিশ্রাম নিলে কমে যায়।
ব্যথার চিকিৎসায় ওষুধ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যথা কমানোর জন্য প্রথমে প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। এতেও যদি ব্যথা না কমে, তখন ইটোরিক্স এবং নাবোমেট স্বল্প মেয়াদে প্রেসক্রাইব করা হয় বলে জানান ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ। ব্যথা সেরে গেলে আবার ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ব্যথা কমানোর জন্য ব্যায়াম বেশ বড় ভূমিকা রাখে। ইয়োগা, তাইচি, অ্যারোবিক, অ্যাকুয়াটিক ইত্যাদি শরীরের মাসল, জয়েন্ট, লিগামেন্ট সুস্থ রাখতে বিশেষভাবে সহায়ক। এ ছাড়া হাড়ের যত্নে সুষম খাবার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ জানান যে একজন মানুষের শরীরে দৈনিক ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের ডায়েটের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম আমরা পাই না। কর্মব্যস্ত জীবনে রোদের নিচে গিয়ে ভিটামিন ডি গ্রহণের সময়টুকু আমাদের থাকে না। এ জন্য দুধ, ছোট মাছ, ফলমূল, শাকসবজি খেতে হবে। ভাত কম পরিমাণে খেতে হবে।
সূত্র: প্রথম আলো