প্রেমিক শচীনের গল্প
- আসিফ
ক্রিকেটার না হলে কি শচীন প্রেমিকই হতেন? প্রেমিক আবার কীভাবে হয়? এটা তো কারো পরিচয় নয়, তবে সম্রাট শাহজাহানের সম্রাট হিসেবে যতটুকু পরিচিতি, রাজ্য শাসনেও কি তাই? তিনি কি রাজ্যের দায়িত্ব নেননি? নিয়েছেন, তবে জীবনে প্রেমের মহত্ত্বে তিনি সবার চোখে অতুলনীয়। তেমনি শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেটে অতুলনীয় হলেও প্রেমেও কম যাননি। শচীনের ক্রিকেটীয় জীবন নিয়ে সিনেমা হয়েছে, কিন্তু প্রেমিক শচীনের জীবন নিয়ে হয়নি।
শচীনের থেকে ৬ বছরের বড়, প্রথম দেখাতেই প্রেম! নাম তার অঞ্জলি। অঞ্জলির সঙ্গে শচীনের প্রথম দেখা ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে। শচীনের বয়স তখন ১৭। ইংল্যান্ড সফর শেষে মুম্বাইয়ে বিমান থেকে নেমেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করা শচীন। মন খুব একটা ভালো নেই। কারণ ফর্মটা ভালো যাচ্ছিল না তার। সেদিন মুম্বাই বিমানবন্দরে বান্ধবীর সঙ্গে এসেছিলেন অঞ্জলি। তখনই চোখাচোখি। এক পলক দেখেই যেন শচীন স্বপ্নে মিলিয়ে যান মহাসমুদ্রের নির্জনে। এরপর হঠাৎ শচীন দেখেন, মেয়েটা তার সামনে নেই! তবে দ্বিতীয়বার তাদের দেখা পেতে খুব একটা সময় লাগেনি। বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছিলেন শচীন, এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছে শচীনের বড় দুই ভাই অজিত আর নিতিন। শচীনের সঙ্গে ছিলো তার বন্ধু। হঠাৎ খেয়াল করলেন মেয়েটা শচীনকে ডাকছে। শচীন একটু ভয়ই পেলেন। বাইরে ভাইয়েরা যদি টের পেয়ে যায় তবে কি হবে?
ওই শেষ দেখার পরে নিজের ক্যারিয়ারের খারাপ সময় এবং সবকিছু মিলিয়ে শচীন আর যোগাযোগ করতে পারেননি মেয়েটার সঙ্গে। তবে অঞ্জলিই যেন শচীনের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই চোখে চোখে প্রেম! আহা! অঞ্জলির এক বন্ধু খেলতেন তখনকার সময় ক্লাব ক্রিকেটে। তার কাছ থেকেই শচীনের বাড়ির টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করেন অঞ্জলি। ওইদিন বিমানবন্দর থেকে ফিরেই অঞ্জলি বাবা-মাকে মজার ছলে বলেছিলেন, বিয়ে করার জন্য একটা ছেলে পেয়ে গেছি!
তখন মোবাইল ফোন ছিলো না শচীন এবং অঞ্জলি করোরই। তাই ফোন করতে হবে শচীনের বাসার ল্যান্ডফোনে। তবে ভাগ্য ভালোই বলতে হবে তাদের। কল করার সময় শচীন ছিলেন বাসাতেই এবং ফোনটা শচীনই সিরিভ করেন। ফোনের ওপাশ থেকে অঞ্জলি শচীনকে বললেন, তিনি বিমান বন্দরে দেখা হওয়া সেই মেয়েটি এবং তিনি শচীনের সঙ্গে আবারও দেখা করতে চান! শুনে শচীন একটু উচ্ছ্বসিত তবে সেটা প্রকাশ না করেই বললেন, হ্যাঁ, আপনাকে মনে আছে আমার। আমরা ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়াতে দেখা করতে পারি। অঞ্জলি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে শচীন তার কথা মনে রেখেছে! মেয়েটি এয়ারপোর্টে কমলা টি-শার্ট এবং নীল জিন্স পরে ছিলেন তাই মনে করিয়ে দিতে শচিনকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি পরে ছিলাম বলুন তো? শচীন সব ঠিক ঠিক উত্তর দিলেন। অঞ্জলির তো আক্কেল গুড়ুম! একি বিস্ময়!
এবার দেখা হওয়ার পালা। ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়াতে দেখা করার সময় শচীন বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেননি অঞ্জলির সঙ্গে। তবে তখন তারা তাদের পার্সোনাল ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে নিয়েছেন ঠিকই। ফোনে কথা বলতে বলতে শচীন অঞ্জলিকে পুরোপুরি চিনে ফেললেন। অঞ্জলি ছিলেন অর্ধেক গুজরাটি আর অর্ধেক ইংরেজ।
অঞ্জলি খুবই ধনী পরিবারের মেয়ে। তবে শচীনকে তার পছন্দ আগে থেকেই। শচীন যখন প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন তখন থেকেই তার ভালো লাগা শুরু। তবে অঞ্জলির প্রেম এবং দেখায় কাকতালীয় হাত রয়েছে তার বাবা এবং মায়ের। এই যেমন অঞ্জলির বাবা ক্রিকেট ভক্ত হওয়ায় মেয়েকে নিয়ে খেলা দেখতে বসতেন বলে মেয়ে প্রথম চিনেছিল শচীনকে। এবং মাকে বিমান বন্দরে সিরিভ করার সময় প্রথম দেখা। কি মধুর ব্যাপারটা!
শচীনের ঘন ঘন ফোন কল এবং কথা বলা তার ভাবির নজরে আসলেও ব্যাপারটা ‘আরে তেমন কিছু না’ বলে শচীন এড়িয়ে যান বার বার। তবে অঞ্জলি কিছুদিন পরেই শচীনের বাড়িতে হাজির, তাও আবার সাংবাদিক পরিচয়ে। সাক্ষাৎ বেশিক্ষণের না হলেও সে সময়ে অঞ্জলিকে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা দুটো চকলেট উপহার দেন শচীন! শচীন হিন্দি ভাষাভাষী এবং অঞ্জলি ইংরেজি ও গুজরাটি ভালো জানেন, তাই সরাসরি দেখায় তাদের খুব বেশি কথা বলা হয়নি। কারণ শচীন ছিলেন ইংরেজিতে দূর্বল!
১৯৯৩ সালে একদিন অঞ্জলির ইচ্ছে হয় শচীনকে নিয়ে যাবেন মেরিন ড্রাইভ দেখতে। কিন্তু জনপ্রিয় শচিন তো এভাবে খোলামেলা বাইরে যেতে পারেন না! লোকে যে চিনে ফেলবে তাকে। তাই নকল দাড়ি এবং চশমা পড়লেন শচীন। হঠাৎই এক সময় সেগুলো খুলে পড়ে গেলে লোকে চিনে ফেলে শচীনকে! সেদিনের ঘটনার পরে প্রায় ৬ মাস দেখা করেননি শচীন অঞ্জলি। শুধু ফোনেই কথা হতো তাদের। এরপর কথাও হঠাৎ কমে যায় দুজনের। শচীন খেলা নিয়ে ব্যাস্ত আর অঞ্জলি তার ডাক্তারি ফাইনাল নিয়ে। পড়াশোনা নিয়ে খুবই সিরিয়াস ছিলেন তিনি। তাই ডাক্তারি ফাইনালেও প্রথম হন অঞ্জলি।
ডাক্তারি শেষে অঞ্জলির চাকরি হয় মুম্বাই থেকে কাছের একটি শহরে। শহরটা এতই ছোট ছিলো যে তারা চাইলেও দেখা করতে পারতেন না। তাই ট্রেনে করে অন্য জায়গায় গিয়ে দেখা করতেন তারা।
শচীনের সঙ্গে প্রেমের কারণে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে অঞ্জলির। ১৯৯২ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ইন্ডিয়ার বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা। শচীন সেদিন খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। এ্যাম্বোস এর বলে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন তিনি। তাতে অঞ্জলির বেশ কষ্ট লাগে। ওই সময় অঞ্জলি এতই হতাশ হয়ে পড়েন যে তার বন্ধুরা তাকে বুঝিয়ে বলেন এ্যাম্বোস খুব ভালো বোলার। তাকে খেলা খুবই কঠিন। শচীন খুব ভালো ব্যাটসম্যান হওয়ায় তার বলটা অন্তত শচীন খেলতে পেরেছিলেন।
বিশ্বকাপ শেষে শচীন প্রথম অঞ্জলির বাড়িতে আসেন। অঞ্জলি তার পরিবারকে মিথ্যা করে বলেন, এটাই তাদের প্রথম দেখা! বিয়ের আগ পর্যন্ত এই মিথ্যাই জেনে আসছিল অঞ্জলির পরিবার। দুই পরিবার তাদের সম্পর্ক নিয়ে না জানায় একটু ভরকে গিয়েছিলেন দুজনই। তারা এবার মনে করেন তাদের সম্পর্কটা বাড়িতে জানানো দরকার। তাই শচীন তার বন্ধুকে দিয়ে বড় ভাই অজিতের সঙ্গে অঞ্জলির দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন।
দেখা হয় শচীনের বড় ভাই ও অঞ্জলির। ওই সময়ে শচীন আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকেন তাদের খবর পাওয়ার জন্য। তিনি চাচ্ছিলেন বিষয়টা পারিবারিকভাবেই ঠিক হোক। অঞ্জলিকে ভালোই পছন্দ হয় অজিতের।
এরপর নিউজিল্যান্ড সিরিজে খেলতে যান শচীন। ওই সময়েই দলের ওপেনার হিসেবে সুযোগ পান শচীন। তখন নিউজিল্যান্ডে বসে তাদের মধ্যে নিয়মিত ফোন আলাপ হতো। আর ওই সময়েই প্রথম প্রেমের মতো প্রথম বিয়ের কথাও শচীনকে বলেন অঞ্জলি। আর শচীন তাকে একটা শর্ত জুড়ে দেন। শর্ত হচ্ছে, অঞ্জলির বাসায় তো অঞ্জলি নিজে বলবেনই এবং শচীন বেশ লাজুক হওয়ায় তার বাসায়ও অঞ্জলির কথা বলতে হবে। উপায় নেই দেখে অঞ্জলি রাজি হয়ে গেলেন।
অঞ্জলি দুই পরিবারে কথা বলার পরে দুই পরিবারই রাজি হয়ে যায় বেশ খুশিমনে। তাদের এক হতে আর কোনো বাধা রইলো না। ফলে শচীন দেশে আসার পরে শচীনের ২১তম জন্মদিনে অঞ্জলির বাড়িতে তাদের বাগদান সম্পন্ন হয়। এরপর ১৯৯৫ সালের ২৫ মে তারা বিয়ে করেন। তবে বিয়ের পরে তাদের দুজনের আলাদা দুটি ব্যাস্ত পেশা হওয়ায় একজনকে তার ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতেই হয় ঘর সামলাতে। তাই শচীনের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে নিজের ডাক্তারি ক্যারিয়ারের ইতি টানেন অঞ্জলি। ৯০ এর দশকের অন্যতম সেরা প্রেম কাহিনী হয়ে থাকবে শচীন-অঞ্জলির প্রেম।
তাই তো ক্রিকেটার শচীন বলেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ জুটিটি তাঁর স্ত্রী অঞ্জলির সঙ্গেই। ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বিদায়ী বক্তৃতায় তীব্র ভালোবাসা নিয়ে শচীন স্মরণ করেন ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ড সফর থেকে ফেরার দিন বিমানবন্দরের ওই মুহূর্তটি। ‘সেদিন আমি দেখা পেয়েছিলাম এমন একজনের, যে আমার সব সময়ের প্রেরণা।’ (ক্রিকেট থেকে বিদায়ের দিন, মুম্বাইয়ের ওয়াঙ্খেরা স্টেডিয়াম, ২০১৩)
বিবাহের পর প্রায় ২৭ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন দুজনে। তাদের দুটি সন্তান—একজন সারা অন্যজন অর্জুন। অর্জনও বাবার মতো ব্যাট-বল হাতে তুলে নিয়েছেন। এবারের আইপিএলে খেলছেন মুম্বাইয়ের হয়ে।