ত্রিশেই কোটিপতি এলিজাবেথ হোমস

ত্রিশেই কোটিপতি এলিজাবেথ হোমস

কাজের মাধ্যমেই মানুষ বেঁচে থাকে। কাজই মানুষকে করে তোলে অন্যের চাইতে আলাদা। আর সেই কাজকে আরো একটু সুন্দর ও সত্যিকারভাবে সফল করে তুলতে দরকার নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ। হাঁ, এমনটাই মনে করেন ত্রিশ বছর বয়সী বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী কোটিপতি এলিজাবেথ হোমস। এবছর ফোর্বস প্রকাশিত ৪০ বছরের কম বয়সী নারী কোটিপতির তালিকায় ৬ষ্ঠ এবং টাইম ম্যাগাজিন প্রকাশিত ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ৫ম অবস্থানে আছেন এলিজাবেথ হোমস। তাঁর প্রমিনেন্ট নারী হয়ে ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন নীলিমা হক রুমা


Untitledনয় বছর বয়সী এক বালিকা তার বাবার কাছে চিঠি লিখলেন, ‘প্রিয় বাবা, আমি জীবনে কি হতে চাই সেটা খুঁজে পেয়েছি। আমি এমন কিছু আবিষ্কার করতে চাই যা কেউ কোনোদিন আবিষ্কারের কথা চিন্তাও করেনি।’

মাত্র নয় বছর বয়সে কী আবিষ্কারের কথা চিন্তা করেছিলেন এলিজাবেথ হোমস? উত্তর আছে ওই চিঠিতেই-‘এমন কিছু আবিষ্কার করবো যার মাধ্যমে রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পূর্বেই রোগ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা যাবে।’

ছোট্ট এলিজাবেথের মাথায় এমন চিন্তা কেন এসেছিল? সেটা আরেক গল্প। সে গল্প না হয় একটু পরে হোক। তার আগে দেখে আসা যাক মেয়ের চিঠি পেয়ে কী করেছিলেন বাবা। তেমন কিছু নয়। সামান্য উৎসাহ দিয়ে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। আর অপেক্ষা করেছিলেন, মেয়ে সত্যিই বড় হয়ে এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারে কি না তা দেখার।

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মেয়ের চিঠি হাতে পাবার পর এলিজাবেথের বাবাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে মাত্র দশ বছর। নয় বছরের বালিকা যখন ঊনিশ বছরে পা রাখেন তখন একদিন বাবা শুনলেন তার মেয়ে সত্যি সত্যিই আবিষ্কার করে ফেলেছে সেই ছোট্টবেলার স্বপ্ন!

এলিজাবেথের স্বপ্নের সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘থেরানস’ যার শাব্দিক অর্থ ‘ডায়াগনোসিস’ এবং ‘থেরাপি’। মুলত রক্ত পরীক্ষা করে বিভিন্ন প্রকার রোগ নির্ণয় করাই তাঁর প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ।

বাবা কি খুব খুশি হয়েছিলেন মেয়ের এমন অবিষ্কারে? তখনকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে অবশ্য বাবার খুশি হওয়ার কোনো কার্যকারণ পাওয়া যায় না। কারণ, মেয়ে এলিজাবেথ স্ট্যানফোর্ড ‍বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে থেরানস! শুধু কী তাই? বাবা-মা অনেক আশা করে যে টাকা জমিয়ে রেখেছিলেম মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার খরচ যোগানোর জন্য সেই টাকাই মেয়ে বিনিয়োগ করেছেন ব্যাবসার কাজে!

মেয়ের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না এখন বাবা-মা নিশ্চয় তা স্বীকার করেন। গর্বে তাদের বুক ভরে যায় যখন শোনেন, তাদের মেয়ে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ কোটিপতিদের একজন।

এবার শুরু হোক সেই গল্প। থেরানস প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন কীভাবে এসেছিল নয় বছর বয়সী এলিজাবেথের মাথায়। এলিজাবেথ বলেন, ‘ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমার এক চাচার অকাল মৃত্যু হয়েছিল। তখন থেকেই ভাবলাম এমন কিছু আবিষ্কার করার। এমন একটা পৃথিবী তৈরি করব, যেন মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীকে বিদায় বলতে না হয়। আমি ভাবলাম, কোন রোগের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই এক ফোঁটা রক্ত পরীক্ষা করে যদি রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় তবে চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।

এলিজাবেথের সেই স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের নাম থেরানস। তাঁর কোম্পানিতে বর্তমানে ১০০টি পরীক্ষা মাত্র এক ফোঁটা রক্ত থেকেই করা সম্ভব।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি সূচ ও রক্ত খুব ভয় পেতেন। নিজের এমন ভয় থেকে অন্যদের কথা চিন্তা করে আর তাঁর প্রতিষ্ঠানে সূচ ও সিরিঞ্জের পরিবর্তে ফিঙ্গারস্টিক দিয়ে ব্যাথাহীনভাবে রক্ত সংগ্রহ করেন। আমেরিকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় পরিবর্তন নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এলিজাবেথ আশাবাদী, আগামি পাঁচ বছরের মধ্যে আমেরিকায় প্রতি পাঁচ কিলোমিটারে একটি করে সেন্টার থাকবে। আমেরিকার প্রতিটি ঘরে ঘরে সহজেই স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
এলিজাবেথকে তাই মনে করা হয় বিস্ময়কর উদ্ভাবক। তার জন্ম ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে।

স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়ে ২০০২ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছিলেন এলিজাবেথ হোমস। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পা দিয়েই নিজের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নেন।

elizabeth- The prominentজনসম্মুখে এলিজাবেথকে প্রায়শ একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আর সেটা হচ্ছে-‘আপনি কীভাবে বুঝলেন স্ট্যান্ডফোর্ডের মতো চমৎকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে ব্যাবসায় যোগ দেয়াটাই সেই সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল?’ উত্তরে এলিজাবেথ বলেন-‘প্রথমত আমি নিজের লক্ষ্য উদ্দেশ্য স্থির করেছিলাম এবং এক সময় মনে হলো আমি আমার লক্ষের ঠিক কেন্দ্রে পৌঁছে গেছি যার পিছনে আমি সমস্থ সময় ব্যায় করেছিলাম। ওই সময়ে আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম আমি যা চাই ঠিক সেই পথের সন্ধান পেয়ে গেছি।’

এলিজাবেথকে দেখে তরুণরা অনুপ্রাণিত হয়ে উদ্যাক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কেউ কেউ তাঁর কাছে গিয়ে বলেন–‘আমি একটি ব্যবসা শুরু করতে চাই’। তখন এলিজাবেথ সেই স্বপ্নবাজ তরুণদের বলেন-‘আমি সবসময় একটা কথাই বলি ‘কেন’? তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন-‘ব্যাবসা করতে হলে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে, সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে। তাছাড়া একটি কাজ বার বার করে যেতে হবে সেটা যতই কঠিন হোক না কেন। যেকোনো কাজে ব্যার্থ হওয়ার খুব বেশি সম্ভাবনা রয়েছে সেটা মেনে নিয়েই চেষ্টা করে যেতে হবে। আমাদের হাজারবার ব্যর্থ হতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষে না পৌঁছাই। তবে এটা নিশ্চিত যে এক হাজার এক বারের সময় সফল হবোই’।

তিনি তরুণ প্রজন্ম নিয়ে অনেক আশাবাদী। তাঁর মতে, অনেক তরুণদের মধ্যে অবিশ্বাস্যরকম নতুন নতুন ধারণা ও ব্যবহারিক জ্ঞান রয়েছে। সপ্নবাজ তরুণদের অনেক বিস্ময়কর উদ্ভাবন দিয়েই সারা পৃথিবীকে পরিবর্তন করে দেওয়া সম্ভব। তবে মাঝে মাঝে তারা মেধা ও শ্রমকে কাজে না লাগিয়েই কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

তিনি বলেন-‘আমার অল্প বয়সে সফল হবার ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে তা হলো আমি সঠিক সময়ে অর্থাৎ সঠিক বয়সে নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম’। তাঁর মতে, সঠিক সময়ে নিজের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই সফলতার মূলমন্ত্র।

ফোর্বস, উইকিপিডিয়া, লিঙ্কডইন অবলম্বনে

Sharing is caring!

Leave a Comment