জিনের বাদশা

জিনের বাদশা

দীপু মাহমুদ : কবির শুয়ে আছে বিছানার উপর। তার দুই হাত আর দুই পা টেনে বেঁধে রাখা হয়েছে। কবিরের বয়স ৫ বছর। লিকলিকে শরীর। কবিরের বিছানার পাশে চেয়ারে বসে আছে খালেক মিয়া। তার পরনে লাল লুঙ্গি। গায়ে কালো ফতুয়া। মাথায় কালো কাপড় জড়ানো। কাঁধে লাল কাপড়ের ঝোলা। খালেক মিয়াকে গ্রামের সকলে জিনের বাদশা বলে ডাকে।

মানুষজন বলে বেড়ায় খালেক মিয়ার সাথে তিনটা জিন থাকে। কোনো মানুষকে ভূতে ধরলে খালেক মিয়াকে ডেকে আনা হয়। সে তার জিন দিয়ে ভূত তাড়ায়।

খালেক মিয়ার মুখ ভর্তি পান। সে জোরে জোরে পান চিবাচ্ছে। এত জোরে পান চিবাচ্ছে যে তার মুখের দুই পাশ দিয়ে পাশের রস বেরিয়ে আসছে। পানের রসে তার ঠোঁট লাল টকটকে হয়ে আছে। খালেক মিয়ার চোখ দুটোও লাল টকটকে। তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে।

সুড়–ৎ করে মুখের ভেতর পানের রস টেনে নিয়ে খালেক মিয়া বলল, ভূত আমার পুত, পেতিœ আমার ঝি, তিনটা জিন সাথে আছে করবি ব্যাটা কি? ভূতের বাপ, ভূতের মা, ভূতের ঝি, ভূতের ছা। দূর- দূর- দূর পালিয়ে যা। পালিয়ে যা।

খালেক মিয়ার হাতে ঝাড়–। ছোট লাঠির মাথায় লাল কাপড়ের টুকরা বাঁধা। সেই লাঠি খালেক মিয়া কবিরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত টেনে আনছে। মুখ দিয়ে পানের পিক ছড়াতে ছড়াতে সে ভূত তাড়ানো মন্ত্র বলে যাচ্ছে।

সকালে আচমকা কবিরের হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। তার গায়ে অল্প জ্বর ছিল। কয়েকবার পাতলা পায়খানা হয়েছে। তারপর পুরো শরীর অবশ আর শক্ত হয়ে গেছে। কবিরের অবস্থা দেখে তার মা হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছেন। কবিরের আব্বা আজিবর হোসেন ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন। গ্রামের লোকজন বলল, কবিরকে ভূতে ধরেছে। তাড়াতাড়ি জিনের বাদশা খালেককে খবর দাও।

হাফিজা কবিরের বড় বোন। সে প্রাইমারি ইশকুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। হাফিজা ইশকুলে শুনেছে ভূত বলে কিছু নেই। ইশকুলে মাহমুদা ম্যাডাম বলেছেন, ভূত হচ্ছে মানুষের বানানো।

হাফিজা গিয়ে দাঁড়াল তার আব্বার সামনে। আজিবর মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনি দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল চেপে ধরেছেন। হাফিজা ডাকল, ‘আব্বা।’

অজিবর মাথা তুলে তাকালেন না। হাফিজা বলল, ‘কবিরের অসুখ হয়েছে। ভূত বলে কিছু নেই। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। ডাক্তার দেখাতে হবে।’

আজিবর মাথা তুলে তাকালেন। তার চোখ টকটকে লাল। তিনি রেগে আছেন। মেয়ের কথা শুনে বললেন, ‘যা এখান থেকে। ছোট মানুষ ছোটদের মতো থাকবি। বড়দের মতো কথা বলিস কেন?’

হাফিজার খুব দুঃখ হলো। সে ছোট বলে তার কথা কেউ শুনতে চায় না। মনে মনে বলল, আমি যখন বড় হব তখন ছোটদের কথা শুনব। হাফিজা মনে মনে বলল বলে সেই কথা কেউ শুনতে পেল না। সবাই ঘরের চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকলে। তারা ভূত তাড়ানো দেখছে। জিনের বাদশা খালেক মিয়া লাঠি নাড়িয়ে মন্ত্র পড়ছে।

কবিরের হাত-পা বিছানার সাথে বাঁধা। সে নড়াচড়া করতে পারছে না। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করছে। কবিরকে দেখে ভীষণ কষ্ট হলো হাফিজার। সে দৌড়াতে দৌড়াতে ইশকুলের দিকে ছুটে গেল। মাহমুদা ম্যাডাম এখন ইশকুলে আছেন। ওয়ান আর টু’র ক্লাস হচ্ছে। থ্রির ক্লাস হয় দুপুরবেলা।

এক দৌড়ে হাফিজা ইশকুলে গিয়ে পৌঁছাল। মাহমুদা আপা হেডস্যারের সামনে বসে আছেন। হাফিজা ইশকুলের বারান্দায় উঠে এসেছে। সে হাঁপাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হেডস্যার দেখলেন হাফিজা ইশকুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো সে কিছু বলতে এসেছে। হাফিজা খুব ভালো মেয়ে। সে সবার কথা ভাবে। মন দিয়ে লেখাপড়া করে। বড়দের শ্রদ্ধা করে। ছোটদের ¯েœহ করে। তাই সবাই তাকে খুব ভালোবাসে।

হেডস্যার হাফিজাকে ভেতরে ডাকলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘হাফিজা কী হয়েছে? তুমি অমন করে হাঁপাচ্ছ কেন?’

মাহমুদা ম্যাডাম হাফিজার মাথায় আদর করে দিলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছে হাফিজা?’

হাফিজা তখন হেডস্যার আর মাহমুদা ম্যাডামকে কবিরের কথা খুলে বলল। সব শুনে হেডস্যার মাহমুদা আপাকে বললেন, ‘আপনি এখুনি হাফিজার সাথে চলে যান। কবিরকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করেন।’

তারপর হেডস্যার বিড়বিড় করে বললেন, ‘কেন যে মানুষজন ভূতে বিশ্বাস করে। ভূত বলে তো কিছু নেই। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য মানুষই ভূত বানিয়েছে।’

হেডস্যার নিচু স্বরে বলেছেন তাও হাফিজা শুনে ফেলেছ। সে বলল, ‘স্যার আমিও জানি ভূত বলে কিছু নেই। মাহমুদা ম্যাডাম বলেছেন। তাহলে মানুষ ভূতের ভয় পায় কেন?’

Genie-poohadventures

হেডস্যার বললেন, ‘ধরো রাস্তার উপর দড়ি পড়ে আছে। তুমি হঠাৎ দেখে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠবে।’

হাফিজা বলল, ‘ওই রকম হয়। দড়ি দেখে হঠাৎ মনে হয় সাপ। ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। আমারও হয়েছিল।’

‘ওটা কি আসলে সাপ ছিল?’

‘না। ওটা একটা দড়ি। রাস্তার উপর পড়েছিল।’

‘তাহলে তুমি ভয় পেলে কেন?’

‘আমি মনে করেছিলাম সাপ।’

‘ভূতও ওইরকম। কিছু একটা দেখে মানুষ ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। তারপর কোনো কিছু খুঁজে না পেলে বলে ভূত। অন্ধকারে যেটা দেখেছিল সেটা হয়তো তখন বাতাসে উড়ে কোথাও চলে গেছে।’

‘এই কথা কেউ বুঝতে চায় না।’

‘যারা পড়াশোনা করে তারা ঠিক বুঝবে।’

তারপর হেডস্যার মাহমুদা ম্যাডামকে বললেন, ‘আপনি তাড়াতাড়ি যান। আহারে ছেলেটা কত কষ্ট পাচ্ছে।’

মাহমুদা ম্যাডাম বললেন, ‘আমার এখন দ্বিতীয় শ্রেণির গণিত ক্লাস আছে।’

হেডস্যার বললেন, ‘আপনার ক্লাস আমি নিয়ে নেব। আপনি তাড়াতাড়ি যান।’

হাফিজার সাথে মাহমুদা আপা ওদের বাড়িতে এলেন। তিনি দেখলেন কবিরকে হাত-পা বেঁধে বিছানায় শুইয়ে রেখেছে। খালেক মিয়া কী সব আজেবাজে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষজন ভীড় করে তাই দেখছে। মাহমুদা ম্যাডাম হাফিজার মায়ের কাছে কবিরের কী হয়েছে সব শুনলেন। তারপর তিনি হাফিজার আব্বার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারসাথে হাফিজার মা এলেন। মাহমুদা ম্যাডাম হাফিজার আব্বাকে সালাম দিলেন।

আজিবর সালামের উত্তর দিয়ে মাহমুদা ম্যাডামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মাহমুদা ম্যাডাম বললেন, ‘কবিরের অসুখ হয়েছে। তাকে ভূতে ধরেনি। এই অসুখটা হচ্ছে এক ধরনের প্যারালাইসিস। শরীর অবশ হয়ে যায়। তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। দেরি করলে সুস্থ নাও হতে পারে। আর যদি সুস্থ হয় তাতেও অনেক সময় লাগবে।’

মাহমুদা ম্যাডামকে সবাই পছন্দ করে। তাকে গ্রামের সকলে ভালোবাসে। তার কথা মন দিয়ে শোনে।

মাহমুদা ম্যাডামের কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন হাফিজার মা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘কবিরকে এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমার কবিরকে তোমরা বাঁচাও।’
হাফিজার মায়ের কান্না শুনে আজিবর উঠে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। তিনি বিছানা থেকে কবিরের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে ফেললেন। খালেক মিয়া চিৎকার করে উঠল, ‘করো কী, করো কী?’

আজিবর বললেন, ‘আমি ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। হাফিজা ঠিক বলেছে, ভূত বলে কিছু নেই। ভূত হচ্ছে মানুষের বানানো। হাফিজা ছোট মেয়ে বলে ওর কথা আগে শুনিনি।’

কবিরকে কোলে তুলে নিয়েছেন আজিবর। খালেক মিয়া কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে নিজের ঝোলা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আজিবর কবিরকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তারসাথে বের হয়ে এসেছেন কবিরের মা, হাফিজা আর মাহমুদা ম্যাডাম। আজিবর ছেলেকে কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। তিনি হাসপাতালে যাবেন।

ডাক্তার কবিরকে দেখে ওষুধ দিলেন। চিকিৎসা শুরু করলেন। ডাক্তার বললেন, দকবিরকে আপনারা ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। দেরি করতে বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত। কবিরের অসুখ আর ভালো করা যেত না।’

ডাক্তার আরও বললেন, ‘শোনেন, ভূত-পেত্নি বলে কিছু নেই। ঝাঁড়ফুঁক করে অসুখ ভালো হয় না। অসুখ ভালো করার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।’

আজিবর বুঝতে পারলেন তিনি হাফিজার কথা না শুনলে অনেক বড় ভুল করতেন। তিনি মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন। আব্বার কোলে উঠে হাফিজার ভালো লাগছে। সে কত বড় হয়ে গেছে। তবুও আব্বা তাকে কোলে নিয়েছেন। আজিবর মেয়েকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করলেন।

কবির ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। সে আছে বিরাট আনন্দে। পরের বছর কবির প্রাইমারি ইশকুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলো। সে প্রতিদিন ইশকুলে যায়। পড়াশোনা করে আর খুশি মনে সবার সাথে খেলা করে। favicon5

Sharing is caring!

Leave a Comment