গবেষক তৈরিই যাঁদের লক্ষ্য
- সুজয় চৌধুরী
করোনার প্রকোপে দেশের শিক্ষার্থীরা যখন ঘরবন্দী, ঠিক সে সময়ে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের দুর্গম গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শ্রাবন্তী দাশ। তাঁর হাতে ফাইল, কাঁধে ব্যাগ আর মাথায় হাজারো প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি ছুটছিলেন এ–বাড়ি থেকে ও–বাড়ি। গবেষণার কাজে ঘরে ঘরে গিয়ে রোগবালাই–সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছিলেন তিনি।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে ছুটে বেড়িয়েছেন তন্ময় চৌধুরী। মূলত উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের সাক্ষাৎকার নিতেই তাঁর এই প্রচেষ্টা। রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থীও গবেষণা কর্মকাণ্ডের জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এ ছাড়া রাত জেগে সিমুলেশনের কাজ আর প্রোগ্রামিং-কোডিং মেলানোয় ব্যস্ত ছিলেন আরেক শিক্ষার্থী ইমরান উদ্দিন।
এই শিক্ষার্থীদের গবেষণার অনুপ্রেরণা এসেছে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ অ্যান্ড হায়ার স্টাডি সোসাইটির (সিইউআরএইচএস)’ কাছ থেকে। শ্রাবন্তী, তন্ময় বা ইমরান গবেষণা–সংক্রান্ত নানা খুঁটিনাটি এ সংগঠনেই শিখেছেন। ইতিমধ্যে তাঁরা গবেষণা প্রবন্ধ তৈরি করে খ্যাতনামা জার্নালে জমাও দিয়েছেন।
এমন আরও শত শিক্ষার্থীর প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করছে সংগঠনটি। গবেষণা আর বিদেশে উচ্চশিক্ষার যাবতীয় তথ্য শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করাই সিইউআরএইচএসের কাজ। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী শিক্ষাবৃত্তির সুযোগ রয়েছে, বৃত্তি পেতে করণীয়, কোন জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ জমা দেওয়া যায়—এমন সব প্রশ্নের উত্তর পেতে শিক্ষার্থীরাও সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।
সম্প্রতি সিইউআরএইচএস আয়োজন করে শরৎকালীন গবেষণা ইন্টার্নশিপ কার্যক্রম। এতে আবেদন করেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১২০ শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সুযোগ পান। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা ও পরিবেশ, কলা ও সমাজবিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন এবং মাল্টিডিসিপ্লিনারি—এ রকম পাঁচটি ক্ষেত্রে ১৮ জন খ্যাতনামা শিক্ষক ও গবেষকদের তত্ত্বাবধানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা মূলত গবেষণার সুযোগ পান। ১২০ জনের মধ্যে ৬৭ শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে গবেষণা প্রবন্ধের কাজ শেষ করেছেন। এসব প্রবন্ধ বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন জার্নালে জমা দেওয়া হয়েছে।
শুরুর গল্প
২০১৯ সালের কথা। প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়েতে ছাপা হওয়া এক প্রতিবেদনে চোখ আটকে যায় রসায়ন বিভাগের ছাত্র তাকবির হোসেনের। প্রতিবেদনটি ছিল মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে নিয়ে। যাঁরা বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়েছিলেন। ওই সংবাদই অনুপ্রেরণা জোগায় তাঁকে। পরে বৃত্তি পাওয়ার প্রক্রিয়া জানতে ঢুঁ মারেন ইন্টারনেটে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ তথ্য খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছিল। এরপর বৃত্তির যাবতীয় তথ্য হাতের মুঠোয় আনার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শরীফ মাহমুদ, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ইকবাল নাফিজ ও তানজিলুর রহমানের সঙ্গে। নানা পরিকল্পনা, আর বহু আড্ডা শেষে মোট ছয়জন মিলে শুরু করেন ‘সিইউআরএইচএস’।
সংগঠনটির বর্তমান সদস্যসংখ্যা ১২ হাজার ছুঁই ছুঁই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও পেয়েছে ব্যাপক সাড়া। দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত যোগাযোগ করছেন সংগঠনের সঙ্গে। ফেসবুক পেজে ফলোয়ার এখন প্রায় ১৫ হাজার। এ ছাড়া সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকেরা। তাঁদের তত্ত্বাবধানেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
সংগঠনের কার্যক্রম
যাত্রা শুরুর পর প্রায় দুই বছরে ৩০টির বেশি সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেছে সংগঠনটি। বিদেশের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও বৃত্তি সম্পর্কিত নানা তথ্যে ভরপুর ছিল সেসব সভা, সেমিনার। এসব অনুষ্ঠানে হাজির হন হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও শিক্ষার্থীরা।
সংগঠনের সভাপতি তাকবির হোসেন বলেন, ইরাসমাস মুন্ডাস, ফুলব্রাইট, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন বৃত্তি নিয়ে অনেকেই পড়তে আগ্রহী। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে হয়, কী যোগ্যতা প্রয়োজন, তা অনেকেই জানেন না। তাই সংগঠন এসব তথ্য সরবরাহ করে। পাশাপাশি সিভি বানানো, ই–মেইল লেখাসহ বৃত্তি পেতে যাবতীয় প্রক্রিয়া জানাতে কাজ করছে এই সংগঠন। সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক গবেষণা সভা করার লক্ষ্য রয়েছে বলে জানান তিনি।
সংগঠনটির তত্ত্বাবধায়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আদনান মান্নান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন, এমন অভিযোগ প্রায়ই শুনতে হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ একেবারেই নেই, এ কথাও চাউর আছে। কিন্তু এ পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় এখন আরও বেশি গবেষণামুখী হয়েছেন। সম্প্রতি সিইউআরএইচএসের একটি ইন্টার্নশিপে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেন। এর মধ্যে বাছাই করে মাত্র ১২০ শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়া গেছে। এই বিশাল সংখ্যাই বলে দেয়, শিক্ষার্থীরা এখন গবেষণামুখী।’
সূত্র: প্রথম আলো