প্রথমদের পরামর্শ
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
শুরু হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। বিগত বছরগুলোতে ভর্তিযুদ্ধে যাঁরা সাফল্যের সঙ্গে জয়ী হয়েছেন, কেমন ছিল তাঁদের ভর্তি প্রস্তুতির দিনগুলো? সেই গল্পই শুনিয়েছেন চার মেধাবী—গত বছর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম স্থান পাওয়া শোয়াইব আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) প্রথম শামসুল নাওয়েদ, ২০১৩ সালের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় সারা দেশে প্রথম আনিকা তাহ্সিন এবং ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম অর্পিতা হক।
আমাদের আলাপ তখনো পরিচয় পর্বে। এর মধ্যেই নড়ে ওঠে পুরো ভবন! ২৪ আগস্ট বিকেলে সারা দেশ কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে যে ভূকম্পন, ঠিক সেই সময় আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম এই চার মেধাবীর। ভূমিকম্পভীতি কাটিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে কথা শুরু হয়। জানতে চাই, এবার যাঁরা ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের প্রতি আপনাদের পরামর্শ কী?
সবার আগে মুখ খুললেন ২০১৩ সালে সারা দেশে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম আনিকা তাহ্সিন, ‘আমাদের পরামর্শ কি সত্যিই কোনো কাজে আসবে? আসলে প্রস্তুতি তো যার যার নিজস্ব ব্যাপার!’ খানিকটা দ্বিমত পোষণ করেন অর্পিতা হক। হাসিমুখে বললেন, ‘আমাকে কিন্তু একজন বলেছে, পরামর্শে কাজ হয়।’ সবগুলো চোখ ঘুরে যায় অর্পিতার দিকে। ‘আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। নতুন ভর্তি হওয়া একজন এসে বলছিল, “আপু, পত্রিকার পাতায় আপনার লেখা পরামর্শ পড়েছিলাম। আমার খুব কাজে এসেছে।”’
গত বছরই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পা রাখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শামসুল নাওয়েদ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শোয়াইব আহমেদ আড্ডায় তখনো নীরব। এই দুজনও ঠিক ‘পরামর্শ’ দিতে রাজি নন। বিনয়ের সঙ্গে বলছিলেন, ‘আমরা কি পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ?’
তবে তাই হোক। পরামর্শ থাক। আমরা বরং গল্প করি। কে জানে, এই গল্পে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো একদিন এমন আড্ডায় যোগ দেবেন এই লেখারই কোনো পাঠক!
কতঘণ্টা পড়ব?
শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, ভর্তি পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীদের একটাই কাজ—নাওয়া–খাওয়া ছেড়ে দিন–রাত শুধু পড়া আর পড়া। সত্যিই কি তাই? চারজন সমস্বরে বলেন, ‘মোটেই না।’ পুরো আড্ডায় ‘মৃদুভাষী’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া শোয়াইব আহমেদের মতে, পড়ার সময় নির্ধারণ করাটা যার যার নিজের ওপর নির্ভর করে। আনিকা বলছিলেন, ‘অনেকে মনে করেন, এই তিন মাস পড়লেই বুঝি চান্স পাওয়া যাবে। তা নয়। প্রস্তুতিটা শুরু হয়ে যায় আসলে একদম কলেজ জীবনের শুরু থেকে।’ অর্পিতা বলেন, ‘আমি তো নিয়মিত টিভি দেখতাম, পত্রিকা পড়তাম আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা বন্ধুদের আড্ডাতেও শামিল হতাম।’
তাহলে সাফল্যের রহস্যটা কী? শামসুল নাওয়েদ জানালেন, ‘গণিতের জন্য আমি প্রচুর চর্চা করেছি। স্কুলে ইংরেজি বিতর্ক করতাম। সেটাও খুব কাজে এসেছে।’
একাগ্রতা, অনুপ্রেরণা
অর্পিতা হকের স্কুল ও কলেজ ছিল বাগেরহাটে। এসএসসিতে জিপিএ–৫ ফসকে গিয়েছিল। তবে দমে যাননি অর্পিতা। এইচএসসিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, সবার সেরা হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছেন। কী ছিল অর্পিতা হকের অনুপ্রেরণা? তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। তাঁদের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। তাই একসময় মনে হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে ভর্তি হতেই হবে।’
অর্পিতার অনুপ্রেরণার গল্প বাকি সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। একে একে সবার কথাই জানতে চাই। শামসুর নাওয়েদ বলেন, ‘বাবার ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ি। কিন্তু আমার লক্ষ্যই ছিল আইবিএ। বাবাকে বুঝিয়ে আমি শুধু আইবিএ ভর্তির প্রস্তুতিই নিয়েছি।’ আনিকা তাহ্সিন আর শোয়াইব আহমেদের গল্পও এমনই। তাঁরা মেডিকেল আর বুয়েটে ভর্তির জন্যই প্রস্তুতি নিয়েছেন।
আমরাও বকুনি খেয়েছি!
ভালোছাত্ররা কি বাবা–মায়ের কাছে বকুনি খান?
‘আজকে সকালেও খেয়েছি।’ শামসুল নাওয়েদের কথা শুনে বাকিরা হো হো করে হেসে ফেললেন। আনিকা তাহ্সিন ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজে পড়েছেন। ছোটবেলা থেকে সব সময় ফার্স্ট হতেন। বললেন, ‘পড়াশোনার জন্য না হোক, অন্য কারণে তো বকা খেতেই হয়।’ এই ফাঁকে বলে রাখি, ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ প্রবাদ আনিকার জন্যও প্রযোজ্য। সব সময়ের এই ফার্স্ট গার্ল ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এখনো তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গিটার বাজানো শেখেন।
শোয়াইবের আগ্রহ কম্পিউটারে গেম খেলায়। অন্যদিকে অর্পিতা হকও গান শেখার আগ্রহ থেকে ছায়ানটে ভর্তি হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে নিয়মিত হলেও পড়ালেখার চাপে ছায়ানটে ‘ড্রপ আউট’–এর খাতায় নাম লিখিয়েছেন তিনি।
এক পশলা তর্ক
ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে একপশলা বিতর্কও হয়ে গেল এই আড্ডায়। আনিকা তাহ্সিন মনে করেন, ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত গুচ্ছ পদ্ধতিতে। আনিকার যুক্তি ছিল, ‘আলাদা পরীক্ষা হওয়ার চেয়ে একই রকম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে পরীক্ষা নিলে ভালো হয়।’ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির উদাহরণ হাজির করেন আনিকা। তবে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করলেন শামসুল নাওয়েদ। পাকা বিতার্কিকের মতোই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি চালু করে আমরা কিন্তু খুব সুফল পাইনি। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। আমার মনে হয় আগে দেখা উচিত, সারা দেশে একযোগে পরীক্ষা নেওয়ার মতো লোকবল আমাদের আছে কি না। পরীক্ষাটা স্বচ্ছ হবে কি না।’
আনিকা আর শামসুলের বিতর্কে নীরবে সায় দেন বাকি দুজন। অর্পিতা উপসংহার টেনে বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁস হবে না—এটা যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সমন্বিত পরীক্ষাই ভালো। এতে শিক্ষার্থীদের সময় বাঁচবে, কষ্ট কম হবে।’
‘চান্স পাব তো!’
ভর্তি পরীক্ষায় যাঁরা প্রথম হয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এতটুকু নিশ্চিত থাকেন, মেধাতালিকায় ঠাঁই হোক না হোক, ভর্তির সুযোগ পাবেন নিশ্চিত। কিন্তু আমাদের ভাবনার ভুলটা শুধরে দিলেন শোয়াইব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ভালো পরীক্ষা দিয়েছি সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ভয়ে বন্ধুদের কারও সঙ্গে কথা বলিনি। উত্তর না মিললে যদি মন খারাপ হয়।’ শোয়েবের কথা শেষ হতেই শামসুল নাওয়েদ যোগ করেন, তাঁর ভাষায়, ‘আসলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিটি নম্বর গুরুত্বপূর্ণ। ১ বা ২ নম্বরের জন্য দেখা যায় কয়েক শ জনের পেছনে চলে যেতে হয়। আমার মনে হয় আইবিএ ভর্তির ক্ষেত্রে যা আমি পারি, সেটাই বারবার না পড়ে বরং যে অংশটাতে আমি দুর্বল, সেটাই বেশি করে চর্চা করা উচিত।’ ওদিকে অর্পিতা নাকি আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তিনি ভর্তির হওয়ার সুযোগ পাবেন। তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বেশ ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। চান্স পেতে পারি। তবে প্রথম হব, সেটা কল্পনাতেও ছিল না।’
পরীক্ষার সময়টুকু গুরুত্বপূর্ণ
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কখন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরের তিন মাস? পরীক্ষার আগের রাত? ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ভর্তি পরীক্ষার সময়টুকু।’ বলেন শোয়াইব আহমেদ। একটু থেমে তিনি যোগ করলেন, ‘প্রস্তুতি যা–ই নিই না কেন, তার প্রমাণ তো দিতে হয় পরীক্ষার সময়টুকুতেই।’
তাঁর সঙ্গে শামসুল নাওয়েদ যোগ করেন, ‘আমাদের অনেক বন্ধু ছাত্র হিসেবে সবার চেয়ে ভালো ছিল। প্রস্তুতিও নিয়েছে ভালো। কিন্তু তারা অনেকেই ভর্তির সুযোগ পায়নি।’
তাই এবার যাঁরা ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছেন, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আশপাশের মানুষের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে শুধু নিজের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যান। কে জানে, শোয়াইব আহমেদ, অর্পিতা হক, শামসুল নাওয়েদ, আনিকা তাহ্সিনদের মধ্যে কারও সঙ্গে একই ক্যাম্পাসে আপনার দেখা হয়ে যেতেই পারে!