কেমন চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ?
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
জনসংখ্যা অনুপাতে দেশের উচ্চশিক্ষার চাহিদার তুলনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আসন সংখ্যা কম হওয়ায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব ছিল না। এ কারণেই মূলত সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়। জারি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৯২। ওই সময় সরকার প্রথম দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়। ২০১০ সালে নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। সে আইনের মাধ্যমে আরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩টি। আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
আশার কথা: বাংলাদেশে এখন প্রায় ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৬১ শতাংশ। দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারিত হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হচ্ছে। প্রায় আড়াই লাখের ওপর ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে লেখাপড়া করতে যেত। এখন খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীই লেখাপড়ার জন্য বিদেশে যায়। তিন লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিকটবর্তী দেশসমূহ, যেমন ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভারত, তুরস্কের শিক্ষার্থীরা পড়ছে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৬ সালে সরকার অনুমোদিত প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের গ্র্যাজুয়েটরা পাস করার পর ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ পায়। আন্তর্জাতিক মানের বিষয়গুলো পড়ানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মন্দের কথা: ১৯৯২ সালে একটি আইনের ভিত্তিতে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। ১৯৯৮ সালে সংশোধন করা হয় এই আইন। ২০০৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ৫ বছরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাস তৈরিসহ কয়েকটি শর্ত পূরণ করার কথা থাকলেও মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ১৫ বছরে কিছু শর্ত পূরণ করে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসের শর্ত পূরণ তো দূরের কথা, তারা বাসাবাড়ির ফ্ল্যাট, শপিং সেন্টার, গার্মেন্টসের উপরে বা নিচে ঘর ভাড়া করে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা চালায়। মুনাফার জন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা মহানগরে সার্টিফিকেট বিক্রিসহ ব্যবসা চালায়। বিভিন্ন স্থানে আউটার ক্যাম্পাসও চালায়।
আইন না মানা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাগ খুলেছে কিন্তু ব্যবহারিক ক্লাস করার জন্য কোন উপকরণ নেই। নেই পর্যাপ্ত ও যোগ্য শিক্ষক। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও বিব্রত হতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় করা টিউশন ফি ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যাচ্ছে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট আসনের ৬ শতাংশ দরিদ্র ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের সম্পূর্ণ বিনা বেতনে ভর্তি করানোর সুবিধা। এর মধ্যে ৩ শতাংশ থাকবে দরিদ্র পরিবারের ও বাকি ৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান। কিন্তু এগুলো মানছে না সব বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের দ্বন্দ্ব সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। এ কারণে অন্য বিষয়ের দিকে তাদের কোন নজর নেই। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই যোগ্য ও সিনিয়র শিক্ষক। কখনো শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন না এমন কর্মকর্তাও অবসরে গিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে যান, ক্লাস নেন। কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন শিক্ষকদের এক একটা ট্রেনিং সেন্টার। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন অন্য প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর চেয়েও কম। সরকারের কঠোর তদারকির মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কাঙ্খিত মানের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
ম তা ম ত
শিক্ষার গুণগত মান অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ
নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষামন্ত্রী
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের বিদেশ গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারিত হচ্ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে চরম বিশৃঙ্খলা ও নাজুক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ একটি সম্ভাবনাময় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠছে। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, ব্যর্থতা, স্বার্থ ও মুনাফালোভী মনোভাবসহ অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে রয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান ও বিশ্বমান অর্জন এবং শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসার জন্য নয়
অধ্যাপক আবদুল মান্নান
চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন
ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢালাওভাবে খারাপ বলা যাবে না। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চলছে। ভালো মানের শিক্ষাদান হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন মেনে চলতে বাধ্য। কোন প্রতিষ্ঠান যদি আইন না মানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসার জন্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এমন করছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আদালতের স্টে অর্ডার নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা করা যাবে না, এ কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না। শিক্ষার মানের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে এজন্য এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল করা হবে।
মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে
প্রফেসর ড. আবুল হোসেন সিকদার
সদস্য সচিব, বোর্ড অব ট্রাস্টি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি
অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই ভালো করছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ভর করছে শিক্ষকদের ওপর। তাই শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা রাখতে হবে। মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের মান ভালো নয়। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দৃষ্টি দেয়া উচিত। উদ্যোক্তা যারা সমাজ সেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে, তাদের সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করতে হবে। কিন্তু যারা ব্যবসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে সে সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হবে। আমার মনে হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি তদন্তের মাধ্যমেই খুঁজে বের করতে পারবে, কারা শিক্ষার নামে ব্যবসা করছে। এ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাস্টি বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে
অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মন
উপাচার্য, আশা ইউনিভার্সিটি
ভালো মন্দ মিলিয়েই চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কোনটা ভালো, আবার কোনটা তত ভালো নয়। এখন উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে। এ কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। শিক্ষা ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে পরিচালনা করা উচিত নয়। যাদের অর্থ রয়েছে, তারা সমাজ উন্নয়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যবসায়িক মনোভাব পরিহার করা উচিত। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরো সহযোগিতা করা উচিত। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় অনুদান পায়, কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পায় না।