‘হেলপারি করে ক্যামেরা কিনেছিলাম’

‘হেলপারি করে ক্যামেরা কিনেছিলাম’

বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের ক্রান্তিকাল বলা চলে বর্তমান সময়কে। মূলধারার চলচ্চিত্র দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। নির্মাতাদের যোগ্যতা নিয়ে স্পষ্ট প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে রুচি নিয়ে। একের পর এক সিনেমা হল যখন নিয়মিত বিরতিতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন মুদ্রার অপর পিঠে ভেসে উঠছে আশার নতুন আলো। সে আলো আসছে আমাদের তরুণদের কাছ থেকে।

শত শত স্বাধীন চলচ্চিত্রকারের একজন যুবরাজ শামীম। যুবরাজ প্রকৌশল বিষয়ে পড়ছেন উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে। পাশাপাশি ‘আমাদের পাঠাগার ও নৈশ বিদ্যালয়’ নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে ৪০ জন পেশাজীবী মানুষকে পাঠদান করে চলেছেন। স্বপ্নবাজ এই তরুণ এরই মধ্যে শুরু করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাণ। তাঁর নির্মিত স্বাধীন চলচ্চিত্র ‘পুতুল’ বেশ প্রশংসিত হয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য একসময় তিনি কন্সট্রাকশনের কাজ করেছেন হেল্পার হিসেবে। তরুণ এই চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে কথা বলেছেন হাসনাত কাদীর


প্রশ্ন : চলচ্চিত্র নির্মাণে কেন এলেন?  মানে স্বপ্নের শুরুটা কভাবে?

যুবরাজ : ছোট বেলায় মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হোটলে বসে পুরি খেতাম আর সিনেমা দেখতাম। তারপর বন্ধুদের সেই সিনেমার গল্প বলতাম। গল্প বলার সময় অনেক কিছু নিজের মতো করে বানিয়ে বলতাম যাতে গল্পটা আরো আকর্ষণীয় হয়। তো পুরি খাওয়া, ছবি দেখা আর গল্প বলাটা আমার নেশা হয়ে গেল। যেদিন টাকা না পেতাম সেদিন হাটতে হাটতে ‘চম্পাকলি’ সিনেমা হলের সামনে চলে যেতাম। সিনেমার পোস্টার দেখে এসে গল্প বানিয়ে বলতাম বন্ধুদের। আর রাতে স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে অনেক বড় নায়ক হব! এখন মনে হয়-আমার সিনেমা-প্রেমের প্রথম কারণ হয়ত হোটেলের গরম গরম পুরি!

প্রশ্ন : স্বপ্ন দেখলেন নায়ক হবেন। কিন্তু চলে এলেন পরিচালনায়…।  

যুবরাজ : ২০০৭-০৮ সালের কথা। বিটিভি’তে ‘মাটির ময়না’ ‘লালসালু’ ‘রাবেয়া’ এই ধরনের সিনেমা দেখাত। ‘মাটির ময়না’ আমার স্বপ্ন বদলে দিল। নায়ক হওয়ার বাসনা হটিয়ে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন গেড়ে বসল আমার ভেতর। কী করি? কী করি?  আমার এক বন্ধু এমপি ফোর বিক্রি করবে। মনে হলো ক্যামেরা কিনতে হবে। কিন্তু টাকা তো নাই। ৭ দিন হেলপারি করলাম কন্সট্রাকশন কাজে। পনেরোশো টাকা পেলাম। এক হাজার টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম এমপি ফোর। শুরু হলো ছেলেবেলার সিনেমা বানানোর হাতেখড়ি!

প্রশ্ন : শুরুর গল্পটা শুনতে চাই

যুবরাজ : মাথায় ভূত চেপেছিল। শুরুটা তাই ভূতের গল্প দিয়ে। সেটা ২০০৮ সাল। কিন্তু সেসব ছবি একটাও শেষ হয়নি। কীভাবে হবে? সিনেমা বানানোর কিছুই তো বুঝি না। লাভ যেটা হলো সেটা হচ্ছে আমি যে সিনেমা বানাতে জানি না তা জেনে গেলাম।

তরুণ নির্মাতা যুবরাজ শামীম। ছবি : সংগৃহীত।
তরুণ নির্মাতা যুবরাজ শামীম। ছবি : সংগৃহীত।

প্রশ্ন : তারপর?

যুবরাজ : ২০১০। একা একা শাহাবাগে ঘুরে বেড়াই। এখানে নাকি সিনেমার লোকেরা চা-বিড়ি খায়। যদি কারো সাথে পরিচিত হওয়া যায়। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমা দেখতে গিয়ে পরিচয় হলো ডাচ চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্লিমেনটাইন এডারভিনের সাথে। তিনি আমাকে ঢাকা ফিল্ম ওয়ার্কসপে ঢুকিয়ে দিলেন। পরিচয় হলো জামান ভাই, শিবলী ভাইয়ের সাথে। আমরা সবাই গড়ে তুললাম ‘সিনেমাকার’  নামে একটা সংগঠন। পুরোটাই জামান ভাইয়ের স্বপ্ন। শুরু হলো আমাদের যা আছে তাই নিয়েই সিনেমা বানানো। জামান ভাই আমাকে প্রভাবিত করলেন, সাহস যোগালেন। তিনি আমার লেখা গল্প নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘জংশন’। এটা একটি ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম। আমি তাতে সহকারী হিসেবে কাজ করলাম।

জামান ভাইয়ের হাত ধরেই সত্যজিৎ, ঋত্তিক ঘটক, মৃণাল সেন, আইজেস্টাইন, তারকভোস্কি, ইঙ্গমার, কিয়ারোস্তামী, কুরোসুয়া, ইনারিতু এমন আরো অনেকের কাজের সাথে পরিচিত হতে লাগলাম। জামান ভাই তখন ‘যাত্রা’ নামে আরেকটি ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম শুরু করলেন। আমি তাঁর সহকারী। তাঁর অনুপ্রেরণায় ২০১৪ সালে শুরু করলাম আমার ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ‘পুতুল’।

প্রশ্ন : ‘পুতুল’ নির্মাণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যদি বলেন।

যুবরাজ : ‘পুতুল’ নির্মাণ-অভিজ্ঞতা অল্প কথায় ব্যাক্ত করা সহজ নয়। তবে পুতুলে আমি বুঝলাম ছবি বানানো শেখার সবচে’ ভালো পদ্ধত্বি হচ্ছে ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়া। পাঁচ বছর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করে আপনি যা শিখবেন তাঁর চেয়ে অনেক ভাল শেখা যায় নিজে একটি পাঁচ মিনিটের ফিল্ম বানালে। পুতুল আমাকে শিখিয়েছে একজন পরিচালক এবং অভিনয় শিল্পীর মধ্যে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত। এবং অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও কাজ করা সম্ভব যদি প্যাশনের জায়গা ঠিক থাকে। আরেকটা বিষয়- পুতুলের কাছ থেকে শিখেছি প্রোডাকশনের জন্য প্রি-প্রোডাকশন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষা আমার পরবর্তী শর্টফিল্ম ‘অনামিকা’য় খুব কাজে এসেছে।

প্রশ্ন : আপনি তো একজন ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার। যেটাকে মূল ধারার চলচ্চিত্র বা কমার্শিয়াল ফিল্ম বলা হয় সেই ধারার চলচ্চিত্র নির্মানের ইচ্ছা আছে?

যুবরাজ : প্রচলিত এই ধারা-টারায় আমার মাথা ব্যাথা নাই। ধরেন বাংলাদেশের প্রতিটা সিনেমা হলে আমরা যারা স্বল্প ব্যয়ে, অল্প রঙের সিনেমা বানাই তাদের সিনেমা দেখতে শুরু করলেন দর্শক। তখন তো আমাদের সিনেমাকেই বলা হবে মূলধারা।

প্রশ্ন : আমাদের চলচ্চিত্রে এখন দর্শক খরা যাচ্ছেকেন? এর প্রতিকার কীভাবে সম্ভব?

যুবরাজ : দর্শককের জন্য ভালো কিছু নির্মাণ করলে দর্শক অবশ্যই সিনেমা হলে আসবে। কিন্তু আসার জন্যে সেই হলটা তো লাগবে। হল বলতে আমি হলের পরিবেশের কথা বলছি। আমি নিয়মিত সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখি। কিন্তু ২-৩ টা হল বাদ দিলে তো পরিবার নিয়ে যাওয়ার মতো দেশে কোনো হল নাই। যত দিন হলের পরিবেশ ঠিক না হবে ততদিন ভালো ছবিও হলে দর্শক পাবে না। ব্যাপারটা হতাশার। তবে আশার কথা হচ্ছে তরুণরা হতাশ নন। তারা বানাচ্ছেন। দর্শক হলে না গেলে হল চলে যাবে দর্শকের কাছে। ইউটিউব তো আছে অন্তত। মন্দের ভাল হিসেবে।

নৈশ বিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে। ছবি : সংগৃহীত।
নৈশ বিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে। ছবি : সংগৃহীত।

প্রশ্ন : বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের এখন একটি ক্রান্তিকাল চলছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তরুণদের কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেন কি? তাদের সবচে’ ইতিবাচক দিকটি কোথায়?

যুবরাজ : আপনি যদি চোখ-কান খোলা রাখেন তাহলে দেখবেন প্রচুর তরুণ-তরুণী এখন ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম বানাচ্ছেন। এঁরা অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই বানাচ্ছেন। সকালের নাস্তা, বিকালের চায়ের পয়সাটা বাঁচিয়ে তারা ছবি বানান। ছবি বানানোর টাকা যোগাতে লেগুনা আর লোকাল বাসে কন্ট্রাক্টরি করার উদাহরণও পাবেন অনেক। তাদের ছবিতে চটচটে রঙ নেই। ঝাঁ চকচকে শট নেই। কিন্তু গল্প আছে। জীবন আছে। পাবেন ন্যাচারাল অভিনয়। আর বাংলার খাঁটি গন্ধ। তারা বিশ্বাস করেন, চলচ্চিত্র হল জীবনের জন্য পর্দায় জীবন্ত ভাবে জীবনকে তুলে আনা। এই বিশ্বাসই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবচে’ বড় আশীর্বাদ।

প্রশ্ন : চলচ্চিত্রকার হিসেবে আপনার স্বপ্ন কী?

যুবরাজ : স্বপ্ন তো অনেক। কোনটা বলি? আমার একটা রোম্যান্টিক স্বপ্ন হলো ‘চলে গেলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা যুবরাজ শামীম।’ এমন একটা পরিচয়ে বিদায় নেওয়া।

প্রশ্ন : বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?

যুবরাজ : এখন ‘ছুটি’ শিরোনামে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখছি। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ না। আমার একটা গল্প থেকেই চিত্রনাট্য করছি।

প্রশ্ন : সিনেমা বানানোর বাইরে কী করছেন?

যুবরাজ : চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরের কাজ বলতে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘আমাদের পাঠাগার ও নৈশ বিদ্যালয়’ নামে একটা সেচ্ছাসেবী সংগঠন চালাচ্ছি। আমাদের এই সংগঠনের আওয়তায় একটি পাঠাগার এবং একটি নৈশ বিদ্যালয় পরিচালিত হয়। সেখানে বর্তমানে ১৪২ জনের মতো কর্মজীবী ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে।

হাসনাত কাদীর : আপনাকে ধন্যবাদ।

যুবরাজ : আপনাকেও ধন্যবাদ।

যুবরাজ শামীমের চলচ্চিত্রের লিংক : https://vimeo.com/114468014

Sharing is caring!

Leave a Comment