স্বর্ণজয়ী সাগর
- মো. আসাদুজ্জামান
পুরো নাম মাহফিজুর রহমান। বন্ধুরা ‘সাগর’ বলেই ডাকেন। সাঁতারের সঙ্গে সখ্যতা একটু বেশী বলে কেউবা আবার ডাকে জলমানব বলে! পড়ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ঐতিহাসিক বিষয়াবলি খুববেশী কাছে না টানলেও নিজেই ইতিহাস হয়ে থাকবেন এমনটাই যেন ইচ্ছে তাঁর। একই সঙ্গে আছেন বাংলদেশ নৌবাহিনীতে। মুক্তিযোদ্ধা বাবা আজিজুর রহমানেরও স্বপ্ন ছিল ‘ছেলে দেশের জন্য ভাল কিছু করবে।’ নিজেও ছিলেন কাবাডি খেলোয়াড়। জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েও অসুস্থতার জন্য খেলতে পারেননি। সেই অপ্রাপ্তিগুলো যেন প্রিয় সন্তানরা পূরণ করে দেবেন। হতাশ করেননি তাঁর সন্তানেরা। বাংলাদেশের পতাকাকে উড়িয়েছেন বিশ্বমঞ্চে। অল-থাইল্যান্ড ওপেন সাঁতার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতে আবারও ইতিহাসই জন্ম দিলেন জলমানব খ্যাত মাহফিজুর রহমান সাগর। এই ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে স্বর্ণজয়ের পথে তার সময় লেগেছে ১ মিনিট ৫৪.০৫ সেকেন্ড। যেটি কিনা সেই ইভেন্টের জাতীয় রেকর্ডের চেয়ে ভাল টাইমিং।
পাবনার ছেলে সাগরের সাঁতারে হাতেখড়িটা হয়েছে ছোটবেলা থেকেই। বছরখানেক পড়েছেন পাবনা জিলা স্কুলে। তারপরে ঢাকায় আসা। ভর্তি হন বাংলাদেশ ক্রীড়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপিতে)। বাবার স্বপ্ন ছেলে দেশসেরা সাঁতারু হবে। তাই বাবা উৎসাহ দেন অনেক বেশী। তখন ২০০৩ সাল। পড়েন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। সাগর যোগ দেবেন জাতীয় বয়সভিক্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায়। কিন্তু বারণ আসে অনেকের কাছ থেকেই ‘এত অল্প বয়সে জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার দরকার নেই।’ কিন্তু সাঁতারপ্রিয় সাগর তা মানবেন না। সাফল্য আনতে চান। তার প্রমাণ অবশ্য দিলেন ঠিকই। দুটি সোনাসহ রূপা আর ব্রোঞ্জ মিলে ছয়টি পদক জিতলেন সেই প্রতিযোগিতাতেই! বছর দুই পরে ২০০৫ সালে তো ২১তম জতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় দেশের ‘সর্বকনিষ্ঠ সাতারু’ হিসেবে জেতেন স্বর্ণপদক। তারপর আর পিছে তাকাতে হয় নি। শুরু হয় সোনালি জীবনের নতুন অধ্যায়। যার ধারাবাহিকতায় ২০০৬, ০৭, ০৮, ১০, ১১ পর্যন্ত বয়সভিত্তিক কিংবা জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অব্যাহত থাকে তাঁর সাফল্য। তবে ২০১১ সালে প্রাপ্তি একটু বেশীই হয়। সেবার আটটি ইভেন্টের আটটিতেই সোনা জিতে হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়। আবার ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে সাতটি সোনা আর একটি রূপা জিতে তিনি হন ছয় হাজার ৫০০ জন অ্যাথলেটের সেরা একজন!
আন্তর্জাতিক সাঁতার সংস্থা (ফিনা) আয়োজিত ওই কার্যক্রমে অংশ নেয়া বিভিন্ন দেশের সাঁতারুর অংশগ্রহণে থাইল্যান্ড ওপেন অনুষ্ঠিত হয়। ৫০ ও ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল ইভেন্টে যথাক্রমে পঞ্চম ও চতুর্থ হয়েছেন পাবনা থেকে উঠে আসা এ সাঁতারু। গোয়াহাটি ও শিলংয়ের যৌথ আয়োজনের এসএ গেমসের ৫০, ১০০, ২০০ ও ১৫০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল ব্যক্তিগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জয় করেন মাহফিজুর রহমান সাগর। এছাড়া ৪৪০০, ৪২০০ ফ্রি-স্টাইল রীলে ও ৪১০০ মিডলে রীলে ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন অন্যতম দেশ সেরা এ সাঁতারু। সাফল্য ধরে রাখেন ইন্দো-বাংলা বাংলাদেশ গেমস, ২০১০ সালে সাউথ এশিয়ান গেমস, ইয়ুথ এশিয়ান গেমস ২০০৯, ইয়ুথ এশিয়ান অলিম্পিক ২০১০, বার্সেলোনায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে, ১৯তম কমনওয়েলথ গেমসের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এ সাঁতারু বর্তমানে থাইল্যান্ডে আছেন রিও অলিম্পিকের বিশেষ প্রশিক্ষণে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক সংস্থার (আইওসি) অলিম্পিক সলিডারিটি ফান্ডে রিও অলিম্পিকের বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হন এ সাঁতারু। স্বাগতিক থাইল্যান্ড, চায়না, হংকং, ভারতসহ অন্যান্য দেশের সাঁতারুরা এ কার্যক্রমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তবে সাগর জানাচ্ছিলেন তাঁর অনন্য এক পাওয়ার কথা, ‘দেশীয়-আন্তর্জাতিক অনেক খেলার মাধ্যমে দেখা হয়েছে মাইকেল ফেলপস থেকে শুরু করে উসাইন বোল্টসহ অনেক খ্যাতিমান তারকাদের সাথে। তাদের থেকে শিখেছিও অনেক। তবে এর মাঝে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাটাই আমার কাছে কাছে গর্বের বিষয় মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আমিই বাংলাদেশ।’
তরুণদের জন্যও রয়েছে তার বিশেষ পরামর্শ। জানতে চাইলে এমন উত্তর দেন তিনি, ‘প্রথমে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। তারপর প্রশিক্ষণ এবং শৃঙ্খলা মেনে লক্ষ্যের প্রতি এগোতে হবে।’