চারুকলার রনির গল্প
- মো. সাইফ
অন্যান্য শিশু’দের মতো শৈশব নয় তার। ছোটবেলা থেকেই একটু যেনো ব্যাতিক্রম,স্বতন্ত্র-সবার চেয়ে কিছুটা আলাদা-অন্যরকম ভাবে জীবনকে দেখতে পাওয়া। মাঠে যখন ছেলেপুলেরা খেলাধুলা করছে রনি তখন পড়ছে খবরের কাগজ। কাগজের পাতায় কতশত আর্টিস্ট এর চিত্র ছাপা হতো। হাতে আঁকা সেইসব ছবি মন কাড়তো রনির। নিজেও আঁকতে চাইতেন। একসময় তার ছবিও যুগান্তর,প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। রক্তে লেগে থাকা আর্ট এর ছোঁয়া নিয়ে বড় হওয়া ছোট্ট সেই রনিই এখন চারুকলার রায়হান রনি হয়ে উঠেছেন।
- ২৩ শে তেইশ
২৩ নিছকই কোনো সংখ্যা নয় রনির জীবনে । হয়ত চারুকলার পড়বেন এর জন্যই তার জন্ম এমনটাই মনে করেন রায়হান রনি। মানিকগঞ্জের সন্তান রনির জন্মতারিখ ২৩শে আগস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদ এর ২৩ তম ব্যাচ এর ছাত্র তিনি। আত্মবিশ্বাস এতটাই প্রবল ছিলো তার যে শুধু “চ” ইউনিট এ ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন চারুকলায়,সম্মিলিত মেধাতালিকায় তার মেধাক্রম সেই অদ্ভুত সংখ্যা ২৩ ! চিত্রকর্মের সাথে জড়িয়ে আছেন এমনঅনেক বিখ্যাত মানুষ এর জীবনেও ২৩ সংখ্যাটি জড়িয়ে আছে। পাবলো পিকাসো’র নাম এর অক্ষর ২৩ শব্দে। সালভাদর দালি মৃত্যুবরন করেন ২৩শে জানুয়ারী।
- রনির অবাক আর্টিস্ট হয়ে উঠার ভ্রমণ
ক্লাস সিক্স এ পড়বার সময় একবার এক ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হলো । রনির কাছে রঙ ছিলো না। এক বন্ধু’র কাছ থেকে রঙ ধার করে নিয়ে তিনি গেলেন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। ছোটবেলা থেকে শিক্ষকের কাছে আঁকতে শেখা ছেলেমেয়েরাও সেখানে অংশ নেয়। রনিতো নিছকই সুবিধাবঞ্চিত ইচ্ছের মৃত্যুদেখা এক কিশোর। সেই প্রতিযোগিতায় রনিকে দেয়া হলো পুরষ্কার-শান্তনা বানী। পুরষ্কার না পাওয়া, “তোকে দিয়ে হবে না” এই কথাগুলোই রনির জীবনে সেরা অর্জন। কারন এইসব দেখে-শুনে তার মনে জিদ চেপে যায়। ছবি আঁকার প্রতি তীব্র হয় আগ্রহ। ধীরে ধীরে অসাধারণ শিল্পী হয়ে উঠেন। রঙ এর আঁচড় এ বুনেন এক একটি ছবি। তখনকার দিনে যারা পুরষ্কার পেয়েছিলো তাদের অনেকেই এখন রনির কাছেই ফিরে আসেন। “বন্ধু একটা ছবি এঁকে দাও”-অনুরোধ করে অনেকেই এভাবে। তারাই রনির কাজের প্রশংসা করেন।
- বঙ্গবন্ধু শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে রনি
২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ছবি নিয়ে একটি “আর্ট এক্সিভিশন” হয়। সারাদেশ থেকে অসংখ্য শিল্পী ছবি জমা দেন। এদের মাঝে সেরা শিল্পীদের ছবিই বাছাই করা হয় প্রদর্শনীর জন্য। রনির আঁকা ছবিটি সেখানে ঠাই পায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র স্বাক্ষরিত একটি সনদ ও সম্মাননা পান রনি বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকে।
- রনির অনুপ্রেরণা ও চারুকলা নিয়ে ভাবনা
প্রখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর বড় ভক্ত রায়হান রনি। তার সাথে একবার এর জন্য হলেও দেখা করতে চেয়েছিলেন রনি। কস্টের ব্যাপার হলো,চারুকলায় রনির যেদিন প্রথম ক্লাস সেদিন কাইয়ুম চৌধুরী মারা যান। দেখা হয়েছিলো তবে কথা হলো না। এছাড়া লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির কাজ ও পছন্দ করেন তিনি।
চারুকলা নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন রনি। তিনি চান চারুকলার আধুনিকায়ন হোক। গ্রাফিক্স – এনিমেশন এর ব্যবহার শেখানো হোক। বিদেশী মুভি প্রচুর দেখেন। তাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাথে তুলনা করলে বলতেই হয় দেশী সিনেমার বাজার এবং মান প্রচুর পিছিয়ে রয়েছে। চারুকলার আধুনিকায়ন হলে সিনেমার উন্নয়ন সম্ভব হবে। টেকনোলজিতে উন্নতি আসবে। রনি আশা প্রকাশ করেন ভবিষ্যতে একটি আধুনিক চারুকলা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করবেন বাংলাদেশে।
ব্যাক্তিগত ভাবে তিনি পিক্সার স্টুডিও’তে কাজ করতে চান। এটি স্টিভ জবস এর প্রতিষ্ঠান যেখানে এনিমেশন নিয়ে কাজ করা হয়। তার স্বপ্ন বাংলাদেশে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে সুযোগ পেলে সেখানে কাজ করতে চান তিনি।
- শিল্পীর দায়বদ্ধতা
রনি বলেন “একজন শিল্পী শুধু তার দেশ নিয়ে ভাবেন তা নয়। তার ভাবনার জগতের বিস্তৃতি পুরো পৃথিবীজুড়ে। শিল্পী একটি ছবি দিয়ে সমাজকে বদলে দিতে পারেন। তাই সমাজ দেশ বিশ্বের প্রতি শিল্পীর যে দায়বদ্ধতা তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।“
এড়িয়ে যেতে পারেননি রনি নিজেও। সমাজসেবামূলক কাজে তার অগাধ আগ্রহ। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। প্রায়ই বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাদেরকে ছবি আঁকা শেখান রনি। সুরবিহার মিউজিক এন্ড আর্ট স্কুলে ছোট ছেলেমেয়েদেরকে ছবি আঁকার দীক্ষা দেন তিনি।
Roy’s নামে একটি ফেইসবুক পেজ চালান রনি। সেখানে প্রায়ই বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ ছাড়ে ছবি এঁকে দেন রনি। এই পেজ এর মাধ্যমে ছবির বিষয়ে কথা বলা যাবে রনির সাথে। রনি মনে করেন কারো রক্ত যদি কথা বলে সে ছবি আঁকবে, ছবি আঁকাটাই নেশা তাহলে সে চারুকলায় পড়ুক কিংবা বাইরে পড়ুক সে ভালো কিছু করে দেখাতে পারবে। এক্ষেত্রে অনুশীলনই একমাত্র “সলিউশন”।
বাবা মায়েরা অনেক সময় তার সন্তান ছবি আঁকবে এটা ভাবতেই পারেন না। গৎবাঁধা কোনো এক পেশায় দেখতে চান সন্তানকে। রনি বলেন,”যে যেটা করতে চায় তাকে সেটাই করতে দেয়া উচিৎ”। আর বর্তমানে চারুকলায় পড়ে কেউ বেকার থাকছে না। টেলিভিশন,চলচ্চিত্র,নাটক,ফ্যাশন হাউজ এমনকি ব্যাংকেও ডাক পড়ে চারুকলার ছাত্রদের। ভালো ছবি আঁকতে পারলে সেটা বিক্রি হয় চড়া দামে।
- সকল শিশু আঁকবে ছবি
রনি বলেন,”ছোটবেলায় আমি দারিদ্র্যের মাঝে বড় হয়েছি। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রঙ তুলি’র দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিনতে পারিনি। ওয়াটার কালারে আমি ভালো আঁকতে পারি। অথচ এই রঙ আমি হাতে পেয়েছিলাম নটরডেম কলেজে পড়ার সময়। অনেকে ছবি আঁকা শিখতো। আমার জন্য সেসব বিলাসিতাই ছিলো একসময়। আমি বিশ্বাস করি ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার ম্যাটেরিয়ালস এবং সাহায্য পেলে হয়ত আজকে আমি আরেকটি ভালো অবস্থানে থাকতাম। যদিও এখনকার দিনগুলো নিয়ে আমি অনেক খুশি।“
রনি চান তার মতো অবস্থায় যেনো কাউকে পড়তে না হয়। কারো আগ্রহ থাকলে তাকে অবশ্যই ছবি আঁকতে দেয়া উচিৎ। একটি শিশু ছবি আঁকার মন নিয়ে জন্মালে সে কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না। কারন ছবি আঁকার মধ্যেই পবিত্রতা রয়েছে। এই পবিত্রতা ধারন করে বেড়ে উঠুক আমাদের শিশুরা। প্রতিটি শিশু আঁকুক ছবি।