ফাহাদের ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ
- আয়েশা আলম প্রান্তি
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ব্যাগ কাধে ক্যান্টিনে হালকা নাস্তা করে ক্লাসে, তারপর সারাদিন আইটেম, কার্ড, টার্ম, ল্যাব নিয়ে পড়ে থাকা। দুপুরে হলে এসে একটু বিশ্রাম আবার বিকেল থেকেই পরের দিনের পড়াশুনার প্রস্তুতি। গৎবাধা মেডিকেল জীবন কিন্তু এটাই। গতানুগতিক ধারায় সব মেডিকেল শিক্ষার্থীই এ জীবন মানিয়ে নেয় কিন্তু দুই একজন থাকেই যারা থাকে স্রোতের বিপরীতে। তেমনই একজন স্বপ্নবাজ সৈয়দ ফাহাদ মুনতাসীর। ভাবলেন কিছু করতে হবে তাদের জন্য যাদের নিয়ে কেউ ভাবে না। সেই ভাবনা থেকেই ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু ’হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি-বাংলাদেশ’ এর। শুরুতেই সঙ্গে পেয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৬৭ ব্যাচের আরও একজন স্বপ্নবাজ মোস্তাকিম বিল্লাহকে। হাঁটি হাঁটি পা করে তিন বছর পেরিয়ে আজ চারের দিকে এই সংগঠন। সঙ্গে আছে তার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরূণ তরুণী। এদের হাত ধরেই এগিয়ে চলা হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশের।
হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশ দেশের অন্যতম বৃহত্তম মেডিকেল স্টুডেন্ট অ্যান্ড ডক্টর ইনিশিয়েটিভ। সবাই যেখানে ভালো স্টুডেন্ট, ভালো ডক্টর এবং সফলদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সেখানে হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশ তাদের হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছে পিছিয়ে পড়া মেডিকেল প্রফেশনালদের জন্য। হার্ট টু হার্ট বিশ্বাস করে মেডিকেল স্টুডেন্ট এবং ডাক্তার তিন ধরণের- ১.পড়তে ভাল লাগে এবং পড়ে (সংখ্যালঘু), ২.পড়তে ভাল লাগে না তবু পড়ে (সংখ্যাগুরু) এবং ৩. পড়তে ভাল লাগে না এবং পড়ে না (তাই ফেল করে, পিছিয়ে পড়ে) [সংখ্যালঘু]। তারা বিশ্বাস করে, প্রথম গ্রুপটির মতো শেষের গ্রুপটিরও মানসিক শক্তি অনেক অনেক বেশি বলেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা পড়াশোনা করে না। শেষের এই গ্রুপটিকে নিয়ে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়া এবং পড়তে ভালো না লাগলেও কষ্ট করে কম্প্রোমাইজ করে পড়ার টেবিলে পড়ে থাকা দ্বিতীয় গ্রুপটিদের জন্য পড়াশোনাকে অনেক বেশি আনন্দদায়ক করার ভিন্নমাত্রিক পড়াশোনা, সাইকোথেরাপি, সাইকোলজি চিন্তা করে হেলথ প্রফেশনালদের সাইকোলজিক্যালি বেটার একটা লাইফ দিয়ে হেলথ সেক্টরকে আরও বেশি প্রোডাক্টিভ সেক্টরে পরিণত করাই হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি-বাংলাদেশের লক্ষ্য।
সামাজিক কাজের ধারাবাহিকতায় এই বছরের শুরুতেই পহেলা জানুয়ারি দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে warmth for the nation and winter medical camp এবং ১৫ জানুয়ারি winter cloth distribution and demographic survey অনুষ্ঠিত হয়। তবে হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় চমক নিয়ে আসে ১ এপ্রিল, প্রায় ৫৫০ মেডিকেল, ডেন্টাল স্টুডেন্ট ও ডাক্তার নিয়ে তারা আয়োজন করে মেডিকেল সেক্টরের সবচেয়ে বড় মেগা ইভেন্ট ’Coping up with Medical Life’ যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মেডিসিন স্পেশালিষ্ট, একুশে পদক জয়ী চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডীন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন National Institute of Cardiovascular Disease এর সহকারী অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের, National Institute of Mental Health এর সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল সহ দেশ বরেণ্য চিকিৎসকবৃন্দ। সাইকোলজিক্যাল সেশন পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম। যেখানে বক্তারা তুমুল প্রশংসা করেন এই ধরনের উদ্যেগের এবং তারা মেডিকেল স্টুডেন্টদের সাইকোলজিক্যাল ক্রাইসিস নিয়ে আলোচনা করেন। তরুণ প্রজন্মকে আগামীর জন্য তৈরি করে নিতে ২২ এপ্রিল কক্সবাজারে হয়ে গেলো 1st Youth Leadership Camp, তার পরের দিনই ২৩ এপ্রিল চট্রগ্রামের লোহাগড়ায় হয়ে গেলো ৩১তম মেডিকেল ক্যাম্প। ধারাবাহিক প্রোগ্রামের মাঝেই ১৫ মে ঢাকার আদ-দীন মেডিকেলে অনুষ্ঠিত হলো ‘Action Against Addiction’ যেখানে দেশ বরেণ্য সাইকিয়াট্রিসগণ বিভিন্ন ধরণের আসক্তির ও সমাধানের উপায় নিয়ে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। তার পরবর্তীতে ২০ মে টাঙ্গাইলের নয়া কৃষি রিসোর্টে হয়ে গেলো এই বছরই ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নতুন ডাক্তারদের নিয়ে ইন্টার্নশিপ গাইডলাইন প্রোগ্রাম। যেখানে নতুন ডাক্তারদের হাতে কলমে ইন্টার্নশীপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দেন তাদেরই অগ্রজরা।
এসব কর্মযজ্ঞ শেষ না হতেই দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানে দেশের স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু এবং টর্নেডো। ততক্ষণাত হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন পাশে দাঁড়াতেই হবে এই মানুষগুলোর। ভোলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তজুমদ্দিন উপজেলার ইউএনও জালাল উদ্দীন ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে ২৫ মে রাতেই ভোলার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মেডিকেল টিম। প্রায় ৪০০ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় এবং ঔষধ বিতরণ করা হয়।
ভোলা থেকে ফিরেই ক্লান্ত শরীরে পরের দিন ভোর ৪ টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে, NICDV এর সহকারী অধ্যাপক ডা. আবুল খায়েরের এলাকায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের উদ্দ্যেশ্যে রওনা। সেখানেই তৎক্ষণাত এক রোগীর অপারেশনের সম্পূর্ণ খরচের দায়িত্ব নেয় সংগঠনটি।
এভাবেই এগিয়ে চলেছে হার্ট টু হার্ট। তাদের চোখে নেই ক্লান্তির কোনো ছাপ।