বাংলাদেশের তিন শিক্ষার্থী মহাকাশ জয়ের পথে
- ক্যাম্পাস ডেস্কঃ
জাপানের কিউশু ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে বাংলাদেশের তিন শিক্ষার্থী তৈরি করছেন ন্যানো স্যাটেলাইট। উৎক্ষেপণ জাপান থেকে হলেও বাংলাদেশে বসে স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণ করবেন এ দেশের শিক্ষার্থীরাই। তাঁদের বিশ্বাস, এই ক্ষুদ্র কৃত্রিম উপগ্রহই একদিন বড় স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগাবে।
বাংলাদেশের তিন শিক্ষার্থী তৈরি করছেন ন্যানো স্যাটেলাইট। মহাকাশে বড় বড় দেশের অবদানের তুলনায় এটা হয়তো মামুলিই। তবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য ছোট্ট একটা কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট বানানো কম কিসে?
নকশা তৈরি, উপকরণ সংগ্রহ, তারপর ন্যানো স্যাটেলাইট বানানো—সব কাজই করছেন তিন শিক্ষার্থী। দলের রায়হানা শামস্ ইসলামকে বন্ধুরা অন্তরা নামেই চেনেন। সঙ্গে আবদুল্লা হিল কাফি ও মাইসুন ইবনে মনোয়ার—তিনজনই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল (ইইই) বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন জাপানের কিউশু ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (কেআইটি)। তাঁদের পড়ার বিষয়ও এই ন্যানো স্যাটেলাইট। তিন তরুণের পড়ার বিষয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে কেআইটির ‘বার্ডস প্রকল্প’। স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ন্যানো স্যাটেলাইট বানানো হবে প্রকল্পের মাধ্যমে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকল্পের নাম ‘বার্ডস’ হলেও বাংলাদেশি স্যাটেলাইটটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অন্বেষা বি–৩’।
তিন তরুণের গল্প সালটা ২০১১। তাঁরা সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে পড়েন। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে নাসার লুনাবোটিকস মাইনিং (খনন করতে পারে এমন রোবট তৈরি) প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। বড়দের এই সাফল্য অন্তরা, মাইসুন ও কাফির মন ছুঁয়ে যায়। আগে থেকেই তাঁদের আগ্রহ ছিল রোবটবিজ্ঞানে। তাঁরা যুক্ত হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস ক্লাবে। ‘ক্লাবে যোগ দেওয়ার আগে আমাদের একসঙ্গে কাজ করা হয়নি।’ বলতে শুরু করেন রায়হানা শামস্ ইসলাম। এরপর থেকেই তিনজনের একসঙ্গে পথচলা শুরু। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রোবট প্রতিযোগিতাগুলোয় তাঁদের দল ‘সেঞ্চুরিয়ানস’ অংশ নেয়। আর অর্জন করে পুরস্কার। সেই সাফল্যের ধারায় তাঁদের মধ্যে জন্ম নেয় স্যাটেলাইট গবেষণার আগ্রহ।
কিন্তু দেশে এ বিষয়ে পড়ার সুযোগ কোথায়? কাফি বলেন, ‘আমি ও মাইসুন জাপানের কেআইটিতে আবেদন করি থিসিস করার জন্য। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তত দিনে ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’ চালু হয়েছে। আমরা থিসিস করার সুযোগ পেয়ে যাই।’ তিন মাসের সে থিসিসে দারুণ সাফল্য দেখান এই দুজন। এরপরই সেখানে স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগ হয়। দুজনের সঙ্গে সুযোগ পান রায়হানাও।
আগামী বছরের মার্চ মাসে তিন তরুণের তৈরি স্যাটেলাইটটি জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নেওয়া হবে। সেখান থেকে মে মাসে তা উৎক্ষেপণ করা হবে।
ল্যাবরেটরির দিনরাত
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের ফারাক পাক্কা তিন ঘণ্টা। যখন কথা হলো তাঁদের সঙ্গে, তখন জাপানে রাত সাড়ে ১১টা। রায়হানা বললেন, ‘আমরা তিনজন এখনো ল্যাবে।’ কাফি যোগ করলেন, ‘আমরা তো একবার টানা ২৬ ঘণ্টাও কাজ করেছি। নমুনা স্যাটেলাইট বানানোর কাজ ছিল সেটা। সময় কম ছিল বলে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে রাতদিন কাজ করতে হয়েছে।’
মেসেঞ্জারে কথা যখন হচ্ছে, তখনো তাঁরা কাজ করে চলেছেন। ২৮ জুন তাঁদের কাজের অগ্রগতি উপস্থাপন করতে হবে জাপান মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কাছে। ‘স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা না থাকা মানেই হলো কোনো বড় সমস্যা লুকিয়ে থাকা।’ বলেন মাইসুন ইবনে মনোয়ার। পরীক্ষার এই ধাপ উতরে গেলে তাঁদের জন্য থাকবে আরও কয়েকটি ধাপ। যেখানে নিরাপত্তা, ব্যবহৃত যন্ত্রের মানসহ নানা বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন বিশেষজ্ঞরা।
জাপানের এই গবেষণাগারে কাজ করেন বার্ডস প্রকল্পের অন্য দেশের শিক্ষার্থীরাও। এ প্রকল্পে বাংলাদেশসহ আরও আছে জাপান, ঘানা, মঙ্গোলিয়া ও নাইজেরিয়া। এই পাঁচ দেশের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজে দেশের জন্য ন্যানো স্যাটেলাইট বানাবেন।
দেশেই থাকছে গ্রাউন্ড স্টেশন
জাপানে ন্যানো স্যাটেলাইট তৈরি বা উৎক্ষেপণের কাজ হলেও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জায়গাটা (গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন) হবে বাংলাদেশেই। সে স্টেশন নির্মাণ করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক দল শিক্ষার্থী। মোজাম্মেল হক, সানন্দ জগতি, বিজয় তালুকদার ও আইনুল হুদা স্টেশন তৈরির কাজে রয়েছেন। এই চার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে স্টেশন নির্মাণে সহায়তা করবে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন সংস্থা (স্পারসো)। থিসিসের অংশ হিসেবে দলটি এরই মধ্যে স্পারসোতে কাজ করছে। কী ধরনের তথ্য তারা সরবরাহ করবে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে, তা নিয়েই কাজ চলছে।
কী কাজ হবে
ক্ষুদ্রাকৃতির এই কৃত্রিম উপগ্রহ কীভাবে কাজ করবে? আর এটা দিয়ে কীই-বা করা হবে? বিষয়টি খোলাসা করে বলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ন্যানো স্যাটেলাইট প্রকল্পের প্রধান মো. খলিলুর রহমান। বললেন, ‘কৃত্রিম উপগ্রহ দুই ধরনের কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়—এক. যোগাযোগ এবং দুই. গবেষণা বা উন্নয়নকাজের জন্য। তবে সেগুলো অনেক বড় আকারের হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীরা যে ক্ষুদ্রাকৃতির কৃত্রিম উপগ্রহটি তৈরি করছে, এটা ৪০০ কিলোমিটার ওপরের কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করা হবে।’ মহাশূন্যের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, দুর্যোগকালীন জরুরি সংকেত, সমুদ্রসীমা এবং কৃষি পরিস্থিতির ছবি পাঠাবে এই ন্যানো স্যাটেলাইট।
তবে এসব কাজের চেয়ে খলিলুর রহমানের কাছে সাফল্যটা অন্যখানে। ‘মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করে এমন দেশের তালিকায় আমাদের নাম উঠবে। আজ ক্ষুদ্রাকৃতির কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়ে শুরু হচ্ছে, একদিন হয়তো বড় আকারের কোনো কাজ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হাতে নেবে।’
এভাবেই মহাকাশ জয়ের শুরুটা হলে মন্দ কি!