তিন তরুণের অ্যাম্বুলেন্স
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
তাঁদের এই কাজের শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে। অনার্সের থিসিসের অংশ হিসেবে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী একটি সৌরচালিত হিউম্যান হলার বানানো শুরু করেন। তাঁরা সবাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়েন। সুপারভাইজর ড. এ কে এম আব্দুল মালেক আজাদের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের আইইই সাইট ইউএসের [স্পেশাল ইন্টারেস্ট গ্রুপ অন হিউম্যানিটেরিয়ান টেকনোলজি, ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্স] আর্থিক সহযোগিতায় হিউম্যান হলার প্রজেক্টের কাজ হয়েছে। সাধারণ রিকশায় যেমন দুজন যাত্রী যেতে পারেন, তাঁদের এই হলারে ছয়জন যেতে পারেন। অনেকটা স্কুল ভ্যানের মতো দেখতে, হলারটি সৌরশক্তিতে চলবে। সৌরশক্তি সার্কিটের মাধ্যমে ব্যাটারিতে এসে জমা হবে। ব্যাটারিতে হলার চলবে। ২০১৪ সালের আগস্টে প্রথম নমুনাটি তৈরি করা হলো। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোল অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন রিসার্চ সেন্টারের [সিএআরসি] পরিচালক ড. আজাদ ছাত্রছাত্রীদের বানানো হলারগুলো ব্যবহারের জন্য ইডকলের [ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট কম্পানি লিমিটেড] সঙ্গে আলাপ করলেন। তারা সূর্যশক্তিচালিত অ্যাম্বুল্যান্স ও কাভার্ড ভ্যান বানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করল। শিক্ষকও সানন্দে সেটি লুফে নিলেন। সেই থেকে শুরু হলো সোলার অ্যাম্বুল্যান্সের কাজ।
গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুরসহ দেশের প্রত্যন্ত জেলাগুলোতে গর্ভবতী মায়েরা আশপাশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার সময় অ্যাম্বুল্যান্স পান না। তাঁদের রিকশায় বা ভ্যানে যেতে হয়। রিকশায় বসে থেকে প্রসবকালীন বেদনা বাড়ে। অথচ শুয়ে বা বসে গেলে এই ব্যথা কমে। প্রয়োজনের সময় প্রাথমিক চিকিৎসাও পান না তাঁরা। অক্সিজেন বা স্যালাইন থাকে না। ফলে কখনো কখনো মায়ের মৃত্যুও ঘটে যায়। এসব গরিব, গ্রামে বসবাস করা হাজার হাজার মায়ের কথা ভেবে কাজে নামলেন তিনজন তরুণ-তরুণী—আতাউর রহমান, শেরি জাহান চৌধুরী ও জাবের আল রশীদ। তত দিনে তাঁরা লেখাপড়া শেষ করে সিআরসিতে গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। অন্যরা অন্যান্য চাকরিতে গেছেন।
তিন গবেষক সে বছরের আগস্টে কাজে নামলেন। অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য চীন থেকে সোলার প্যানেল কিনে আনা হলো। এটি ২০ বছর চলতে পারবে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সৌরশক্তি পেলে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার বেগে ৬০-৭০ কিলোমিটার যেতে পারবে। সৌরশক্তিতে অ্যাম্বুল্যান্সের মোটর চলবে। সে জন্য অ্যাম্বুল্যান্সের দুটি সিটের নিচে দুই সেটের চারটি করে মোট আটটি ব্যাটারি আছে। যদি বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে সূর্যের আলো পাওয়া না যায়, তাহলে ব্যাটারিতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা চার্জ দিলেই হলো। দিব্যি ১০-১১ ঘণ্টা অ্যাম্বুল্যান্স চলতে পারবে। অ্যাম্বুল্যান্সের চলাচল নিয়েও দফায় দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সংযোজন-বিয়োজন চলছিল। প্যাডেলের জায়গায় চীন থেকে টর্ক সেন্সর এনে লাগানো হলো। এই প্রযুক্তিতে প্যাডেল করলেই ব্যাটারির মাধ্যমে মোটর চলতে শুরু করবে। তাতে চালকের শারীরিক ব্যায়াম হবে, ব্যাটারির শক্তিও বাঁচবে। সেন্সরের সার্কিটটি সিআরসিতে বানানো হলো। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে হাতেও প্যাডেল দেওয়া যাবে। ছাদের সোলার প্যানেল থেকে সূর্যশক্তি এসে ব্যাটারিতে সঞ্চিত হবে। সেখান থেকে সার্কিটের মাধ্যমে মোটরে যাবে। সার্কিটটি তাঁদের বানানো। তবে সোলার অ্যাম্বুল্যান্স শুধু মোটরে চলবে না। তাকে প্যাডেল মেরেও চালাতে হবে। তাতে ব্যাটারি, টর্ক সেন্সর ও সোলার প্যানেলের ৭৬ শতাংশ শক্তি সাশ্রয় হবে। জরুরি প্রয়োজনে গতি কমানো বা থামানোর জন্য হ্যান্ড ব্রেকও লাগানো হলো।
অ্যাম্বুল্যান্সের ভেতরে রোগীর জন্য একটি বেড আছে। পাশে আত্মীয় ও নার্স বসার জন্য সিট। রোগীর বেডের পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার, ব্লাড ব্যাগ ও স্যালাইনের আলাদা হুক আছে। আছে ব্যাটারিচালিত ফ্যান। ফার্স্ট এইড কিট রাখার জন্য তিন তাকের তালাঅলা বাক্স আছে। এভাবে পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন করে নমুনা অ্যাম্বুল্যান্স তৈরি করতে তাঁদের এক বছর লেগে গেল। তারপর সেটি পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর জন্য সাভারের গেন্দায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ব্র্যাকের শাখা অফিসে এইচএনপিপি [হেলথ, নিউট্রেশন অ্যান্ড পপুলেশন প্রোগ্রাম] কর্মসূচির আওতায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত সেটি রোগী বহন করে। নানা পরামর্শ এসেছে তখন, তাতে অ্যাম্বুল্যান্সটি আরো উন্নত করা হয়েছে।
প্রথমেই ডাক্তাররা অ্যাম্বুল্যান্স পরিদর্শন করে জানিয়েছেন, রোগীর সিটটি পাঁচ ফুট থেকে বাড়িয়ে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি করলে ভালো হয়। কারণ আমাদের মায়েদের এটিই গড়পড়তা উচ্চতা। ফলে সিটের আকার বাড়ানো হলো। এপর এটি বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কিছুদিন পর জানানো হলো, অ্যাম্বুল্যান্সের চাকা বেশ চিকন, কাদায় আটকে যেতে পারে। ফলে গবেষকরা চীন থেকে কাদায় চলার উপযোগী মিশুকের চাকার মতো চাকা আনালেন। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলার সময় যাতে ঝাঁকুনি না লাগে সে জন্য কেবিনের নিচে স্প্রিং যুক্ত হলো।
প্রসূতি মায়েরাও নানা পরামর্শ দিচ্ছিলেন। যেমন একজন বললেন, লোহার বেডে পাশ ফিরে শোয়ার সময় মাথায় ব্যথা লাগে। ফলে তাঁদের বেডে আরো ফোম দিয়ে সেটিকে উঁচু করা হলো। স্বাস্থ্যকর্মীরা বললেন, সিটের নিচের টিন পায়ে লাগলে ঠাণ্ডা লাগে, ময়লা জমে। ফলে নিচের অংশে কার্পেট বিছানো হলো। তাতে সৌন্দর্যও বাড়ল।
এই একটি বছর তিন গবেষকও অ্যাম্বুল্যান্সের পেছনে প্রচুর সময় দিয়েছেন। জাবের ও আতাউর অনেকবার গেন্দা গিয়েছেন। রোগীকে আত্মীয়ের সঙ্গে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁদের অসুবিধাগুলো শুনে অ্যাম্বুল্যান্স সেভাবে তৈরি করেছেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে এক গৃহিণীকে সাভারের আনন্দপুরের বাসা থেকে আরিফ জেনারেল হাসপাতালে রুটিন চেকআপের পরে আবার বাসায় পৌঁছে দিয়েছেন। তখন তিনি বলেছেন, ‘আগে যেখানে রাস্তায় ৩০ মিনিট লেগে যেত, এখন ১৫ মিনিট লাগে। খুব আরামে যেতে পারি।’ অন্যান্য অ্যাম্বুল্যান্সের মতো এটিতেও আছে জরুরি সংকেত সাইরেন, কেবিনের ভেতরে এলইডি লাইট, চার্জার। টানা এক বছর সোলার অ্যাম্বুল্যান্স সাভারে চলাচল শেষে এখন দেশের যেকোনো জায়গায় রোগী পরিবহনের জন্য প্রস্তুত। অ্যাম্বুল্যান্সের পরিকল্পনাকারী ড. আজাদ ও তাঁর তিন সহকারী জানালেন, তাঁরা এই অ্যাম্বুল্যান্সগুলো সারা দেশের প্রসূতি মায়েদের সেবায় ব্যবহার করতে দিতে চান। কষ্ট করে তাঁদের যাতে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করা না লাগে এবং জীবন ঝুঁকির মধ্যে না পড়েন সে জন্য তাঁরা প্রয়োজনে অ্যাম্বুল্যান্সগুলোকে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে দিতে পারেন।
সিআরসির মাধ্যমে তাঁরা পাঁচটি করে সোলার হিউম্যান হলার, অ্যাম্বুল্যান্স ও কার্গো হলার বানিয়েছেন। সব যানবাহনই সাভারে পরীক্ষামূলকভাবে এক বছর ব্যবহার করা হয়েছে। গ্র্রামে শাকসবজি বা ওষুধের মতো জরুরি পণ্য ভ্যানে পরিবহন করা হয়। তাতে ফসল নষ্ট হয়ে যায়, ওষুধের গুণাগুণের ক্ষতি হয়। এসব জিনিস কার্গো হলারে পরিবহন করলে আর নষ্ট হবে না। ফলে টাকা বাঁচবে, সম্পদ বাঁচবে।