তিনি সাক্ষরতার দূত
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
গতানুগতিক লেখাপড়া তাঁকে কখনো টানেনি। কলেজে পড়ার সময় দেখতেন, স্যার পড়িয়ে চলেছেন, ভালো রেজাল্টের জন্য সেসব নোট মুখস্থ করছে ছাত্ররা। এই লেখাপড়ার মানে কী? শুধু চাকরি পাওয়া? এই প্রশ্নটিই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। নিজেও তিনি ভালো ছাত্র। স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসে দ্বিতীয় হতেন। এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন।
সোনারগাঁওয়ের গ্রামের স্কুল থেকে ঢাকার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হয়ে আরো চোখে পড়ল, শহরের স্কুলগুলোয় কম্পিউটার আছে, গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেগুলো ব্যবহারেরই সুযোগ পায় না। শহরের শিক্ষকরা যেমন পেশাদার, গ্রামে সেটির অভাবও প্রকট। গ্রাম-শহরের এই বৈষম্য ঠেকানো ও আধুনিক শিক্ষা উপকরণের সঙ্গে গ্রামের শিশুদের পরিচয় করিয়ে দিতে রিয়াজুল করিম নিজেই একটি স্কুল চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন তিনি ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন। ভাবনাটি সবার আগে কলেজের অধ্যক্ষ নূরনবী ও শ্রেণিশিক্ষক এজাজ আহমেদের সঙ্গে শেয়ার করলেন। তাঁরা উৎসাহ দিলেন। শুরু হলো কাজ।
কোনো মূলধন ছিল না। সাত বন্ধু—আহমেদ আলী, সোহরাব হোসাইন, আসকর আলী, ইকবাল হোসাইন, মিজানুর রহমান, সাইফুর রহমান ও তিনি মিলে অল্প অল্প করে টাকা দিলেন। এলাকার এক বড় ভাইও সাহায্য করলেন। সে টাকায় স্থানীয় মেম্বার ফজলুল করিমের কাছ থেকে ১২ বছরের জন্য ২০ শতাংশ জমি লিজ নেওয়া হলো। শুরুতেই গ্রামের এই স্কুল অভিভাবকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিল। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করলেন। ২০০৯ সালে ৭৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে চালু হলো ‘চাইল্ড হ্যাভেন কিন্ডারগার্টেন’। নাগেরগাঁও ও আশপাশের এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই ছাত্রছাত্রী। স্কুল বলতে ছোট্ট একটি টিনের ঘর। সেখানে ছয়টি ক্লাসরুম। শুরুতে প্লে থেকে ফোর পর্যন্ত পড়ানো হতো। শিক্ষকরা সবাই বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নামেমাত্র বেতন নেন। আস্তে আস্তে স্কুলে ছাত্রছাত্রী বাড়ল। এখন সেখানে প্লে গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। ক্লাসরুম আছে ১৩টি। ছাত্রছাত্রী ২৯০ জন। ছেলে ১৪৯ জন আর মেয়ে ১৩১ জন। শিক্ষক আছেন ১৮ জন। অন্য স্কুলগুলোর সঙ্গে গ্রামের এই স্কুলের একটি পার্থক্যের কথা বললেন স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা রিয়াজুল করিম—‘আমরা তাদের গুগল ম্যাপে জায়গা চেনাই, তাদের জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা শেখাই।’ তিনি দুঃখ করে বললেন, ‘আমাদের কম্পিউটার মাত্র একটি। বাসা থেকে ল্যাপটপ নিয়ে এসে শিক্ষকরা পড়ান। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য কথা দিয়েছেন আমাদের দুটি ল্যাপটপ দেবেন। তাহলে কিছুটা হলেও চাহিদা মিটবে।’
রিয়াজুল এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে এমবিএ পড়েন। ক্যাম্পাসেও তিনি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করেছেন। এটির নাম ‘এবিসিডি ওয়ার্ল্ড’। এটার শুরুরও গল্প আছে। ২০১৩ সালের রোজার ঈদে বন্ধুরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলেন। এক জায়গায় দেখলেন শিশুরা মাছ ধরছে। তাঁর কৌতূহল হলো, জিজ্ঞাসাও করে বসলেন, ‘ঈদের দিন তোমরা মাছ ধরছ কেন? তোমাদের ঈদের জামা কোথায়?’ মন খারাপ করে ওরা জানাল, জামা কেনার পয়সা তাদের মা-বাবার নেই। মাছ ধরে ঈদের দিন খাবে। পরে ওরা জানাল, স্কুলেও যায় না। সেদিন রাতেই স্কুলের ব্যাপারে আগ্রহ নেই, এমন ছেলেমেয়েদের জন্য খোলা হলো ‘এবিসিডি ওয়ার্ল্ড’। ওদের নিয়ে শব্দভিত্তিক কুইজ, রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ফলে তাদের মধ্যে লেখাপড়ার তাগিদ তৈরি হয়। এখন ছাত্রছাত্রীদের অভাব, অভিযোগ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছে সংগঠনটি।
শিক্ষার আরো অনেক ক্ষেত্রে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন রিয়াজুল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া জাতিসংঘ বা জাহাঙ্গীরনগর মডেল ইউনাইটেড নেশনসের তিনি প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। প্রতিবছর সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, সেগুলো নিয়ে ছাত্রছাত্রীরাও এই সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। তিনি ইউনাইটেড নেশনস ইয়ুথ অ্যান্ড স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনস অব বাংলাদেশের [ইউনিস্যাব] সমন্বয়ক। জেনারেশন ইউনাইটেড নেশনেরও একজন সক্রিয় সদস্য।
শিক্ষাক্ষেত্রে রিয়াজুল করিমের এসব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ব সাক্ষরতা সংস্থা [ওয়ার্ল্ড লিটারেসি ফাউন্ডেশন] বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো তাঁকে ‘সাক্ষরতার দূত’ নির্বাচিত করেছে। ৮ অক্টোবর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে সারা বিশ্ব থেকে যে ৯ জনকে দূত নির্বাচিত করা হয়েছে তিনি তাঁদের একজন। রিয়াজুলের স্বপ্ন, দেশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখবেন।