দুই শিক্ষার্থীর বিশ্বজয়
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
রং পেনসিল হাতে নিয়ে বাংলাদেশের জন্য অন্য রকম গর্ব বয়ে এনেছে দুই শিশুকন্যা। ইতালির রোমে এ বছর বিশ্ব চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে বরগুনার হাদিসা আক্তার (১১) ও বাগেরহাটের বর্ণালী বাগচী (১০)। ১৪টি দেশের শিশু-কিশোররা তাদের আঁকা ছবি পাঠিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এর মধ্যে সেরা আটটি ছবি বাছাই করে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন নির্বাচিত করা হয়, যার দুটি ছবি বাংলাদেশের দুই শিশুকন্যার আঁকা।
এবার গ্লোবাল ডিজাইন কম্পিটিশনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘ক্ষুধামুক্ত ভবিষ্যৎ : আমাদেরই হাতে’। বাংলাদেশের যেসব জেলা ডাব্লিউএফপির স্কুল ফিডিং প্রকল্পভুক্ত, সেসব স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়। বাংলাদেশ থেকে বাছাই করা সেরা পাঁচটি ছবি পাঠানো হয় ইতালির রোমে ডাব্লিউএফপির সদর দপ্তরে।
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হাদিসার বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম কালীবাড়ী। সে কালীবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা আজাহার সরদার (৫০) একজন দিনমজুর। মা সাজু বেগম সেলাই মেশিন চালিয়ে সংসার চালান। লেখাপড়ার পাশাপাশি মাকে সাহায্য করে হাদিসা। দরিদ্র পরিবারের কারণে হয়তো অনেক কিছু জোটে না। এর পরও সৃজনশীল হাদিসা রং পেনসিল জোগাড় করে ছবি আঁকে। তার ছবিতে থাকে খাল-বিল, ঘাসফুল, পুকুর, ফসলের ক্ষেত, পরিবার।
হাদিসা একজন স্বপ্নচারী শিশু। অভাব-অনটনে তার যত না-পাওয়া আছে সেসবের ছবি এঁকে নিজেকে উপহার দেয়। যেমন, তার গ্রামে কারো বাড়িতে টেলিভিশন নেই। কিন্তু তার খুব ইচ্ছা টেলিভিশন দেখার। কিন্তু উপায় কী? ব্যস, হাদিসা কাগজ আর রং পেনসিল নিয়ে বসে গেল। আঁকল একটি টেলিভিশন। এরপর নিজের আঁকা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এভাবেই সে টেলিভিশন দেখে। এই হাদিসা এখন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন শিল্পী।
কন্যার এই অর্জনে দারুণ খুশি মা সাজু বেগম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কোনো ঘর ছিল না। আমার ভাইয়ের বাড়িতে থাকতাম। কদিন আগে আমার ভাইসহ স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় নিজেদের একটা ঘর তুলেছি। সেখানে এখন হাদিসাকে নিয়ে থাকি।’
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় হাদিসা ভীষণ খুশি। অনুভূতি জানাতে গিয়ে সে কালের কণ্ঠকে বলে, ‘বড় হয়ে আমি একজন আদর্শ শিক্ষক হতে চাই।’ এবার গ্লোবাল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় হাদিসা যে ছবিটি এঁকেছিল তার বিষয় ছিল পারিবারিক পরিমণ্ডলে নিরাপদ খাদ্য। বিশেষ করে খাবার আগে হাত ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ঢেকে রাখা খাবারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা।
আরেক ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন শিল্পী বাগেরহাটের বর্ণালী বাগচী। সে ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর ইউনিয়নের মায়ারখালী গ্রামের বিকাশ বাগচীর মেয়ে। বর্ণালী কলকলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির পর থেকে বর্ণালী ছবি আঁকে। তার আঁকা ছবি সব বয়সের মানুষকে মুগ্ধ করেছে। এবার তার ছবি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বর্ণালী বিজয়ী হওয়ার খবরে পরিবার, শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবাই খুশি।
বর্ণালীর শিক্ষক ফকিরহাট ফজিলাতুননেসা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজের চারুকলা বিভাগের প্রভাষক সুকুমার বাগচী বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমি বর্ণালীকে ছবি আঁকানো শেখাচ্ছি। তার এই প্রাপ্তিতে আমি ভীষণ খুশি। বর্ণালী শুধু চিত্রাঙ্কনে নয়, পাশাপাশি নাচে-গানেও পারদর্শী।’
বাগেরহাট জেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অশোক কুমার সমাদ্দার জানান, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় জেলার শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও ফকিরহাট উপজেলায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চলছে। ওই কর্মসূচির আওতায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বর্ণালী বাগচী চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
কলকলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিরামন মণ্ডল বলেন, ‘বর্ণালী চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি লেখাপড়া এবং নাচে-গানে অনেক ভালো। বর্ণালী আমার স্কুলের গর্ব। তার বাবা বিকাশ বাগচী কলকলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর তার মা লাবনী একটি বেসরকারি কলেজে চাকরি করেন।’
পাথরঘাটা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম হায়দার জানান, সারা দেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে অসংখ্য শিশু-কিশোরের আঁকা ছবি থেকে পাঁচটি ছবি পাঠানো হয় জেলায়। এরপর জেলায় আসা ছবিগুলো থেকে বাছাই করে সেরা পাঁচটি পাঠানো হয় ঢাকায়। সেখানেও অসংখ্য ছবির মধ্য থেকে বাছাই করা হয় দেশসেরা পাঁচটি ছবি। এভাবেই ১৪টি দেশ থেকে পাঁচটি করে সেরা ছবি জমা হয় ইতালির রোমে। এরপর শুরু হয় চূড়ান্ত বাছাই পর্ব। নির্বাচিত হয় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সাহিদা আক্তার জানান, আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর পাথরঘাটার পূর্ব কালীবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাদিসা ও তার স্কুলকে পুরস্কৃত করা হবে। সেদিন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, উন্নয়ন সংগঠন সুশিলন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। এ সময় বিজয়ী হাদিসা আক্তারকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাইজ মানি ও সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক ড. বশিরুল আলম জানান, ভালো কিছু করতে দারিদ্র্য যে কোনো বাধা হতে পারে না তা প্রমাণ করেছে কিশোরী হাদিসা। হাদিসার জন্য শুভকামনা।