পঞ্চাশের অপেক্ষায় শাটলের ক্যাম্পাস

পঞ্চাশের অপেক্ষায় শাটলের ক্যাম্পাস

  • ক্যাম্পাস ডেস্ক 

এখানে সকাল হয় শাটলের শব্দে। দিনভর ক্যাম্পাস মুখর থাকে শিক্ষার্থীদের হাসি-গানে। পাখির কিচিরমিচির ধ্বনিতে সন্ধ্যা নামে। রাত গভীরে শোনা যায় শিয়ালের ডাক। বলা হচ্ছে, নিঝুমপুরীর জ্ঞানরাজ্য খ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।

আগামী ১৮ নভেম্বর সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয় পূরণ করবে গৌরবোজ্জ্বল ৫০ বছর। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় সাজবে উৎসবের আবহে। দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধনে পরিণত হবে জমকালো সেই উৎসব। এবার আমাদের আয়োজন পাহাড়ের কোলে শাটলের এই ক্যাম্পাস নিয়ে—

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শাটল​ ট্রেনের সঙ্গে। সম্প্রতি ছবিটি তুলেছেন সৌরভ দাশ

বিশ্ববিদ্যালয় গ্রামে যাবে

বিশ্ববিদ্যালয় গ্রামে যাবে—এ স্লোগানে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম-পট্টি মৌজার সুবিশাল জায়গাজুড়ে এর অবস্থান। শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে এটি তৃতীয় বৃহত্তম এবং আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩টি বিভাগ ও সাতটি ইনস্টিটিউট আছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ হাজারের বেশি। শিক্ষক রয়েছেন ৬৮৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ছয়টি ছাত্রাবাস ও চারটি ছাত্রীনিবাস। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণাধীন রয়েছে। মাস দু-এক পর এটি চালু হওয়ার কথা।

কৃতী কজন

এবিশ্ববিদ্যালয়েরই অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্‌হা, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকও ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন সাজিদ আলী হাওলাদার। এখন তিনি ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি ইউনিভার্সিটির গবেষক। ২০১১ সালে ব্যাঙের নতুন একটা প্রজাতি আবিষ্কার করে সাড়া ফেলেছেন এই তরুণ বিজ্ঞানী। কিছুদিন আগে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। তখন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বন-পাহাড়ে প্রাণিবৈচিত্র্য চোখে পড়ে। ক্যাম্পাসের আনাচকানাচে না ঘুরলে হয়তো আমরা বিজ্ঞানী হওয়া হতো না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুব মিস করি।’

ঝুপড়ি-কথা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আকর্ষণ এর ছোট ছোট খাবারের দোকানগুলো। এগুলো ঝুপড়ি নামে পরিচিত। বিভিন্ন অনুষদকে কেন্দ্র করে ঝুপড়িগুলো গড়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে ‘বিখ্যাত’ হলো কলা অনুষদের ঝুপড়ি। কী নেই সেখানে? চায়ের কাপে রাজনীতির ঝড়, টেবিল চাপড়িয়ে বেসুরো গলায় কোরাস গান, পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নোট আদান-প্রদান। এরই মধ্যে চলে প্রেমিক জুটির মন দেওয়া-নেওয়া, অপলক চেয়ে থাকা।

ক্যাম্পাসে উচ্ছ্বাস

বিকেল বেলার শহীদ মিনার চত্বর। গত ৩ অক্টোবর সেখানে পা রেখেই শুনতে পাই ‘এমন যদি হতো/ আমি পাখির মতো/ উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’ গান ধরেছেন পরিসংখ্যান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এ দলে আছেন সালমা সাহারা, আফসানা আজাদ, রোহানা আক্তার, নাদিয়া সুলতানা, অনুপম চক্রবর্তী ও শাফায়েত হোসাইন। গান শেষ করে সালমা বললেন, ‘পাহাড়ে ঘেরা এ ক্যাম্পাসের সকাল, সন্ধ্যা, বিকেল, রাতের সৌন্দর্য না দেখা হলে মনে হয় জীবনটাই অসম্পূর্ণ রয়ে যেত!’

কলা অনুষদের ঝুপড়িতে ছোট-বড় দলে বিভক্ত হয়ে চলছিল আড্ডা। কেউ গাইছেন গান। কেউ ফেটে পড়ছেন হো হো হাসিতে। মহির উদ্দিন খান, সাজ্জাদ হোসেন, জোবায়েদা খানম ও মেহেদুন রহমান বসেছেন এক দলে। তাঁরা দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। জোবায়েদা বললেন, ‘পড়ছি, হাসছি, আড্ডা দিচ্ছি আর ক্যাম্পাসের মধুর জীবন উপভোগ করছি।’

ব্যক্তিত্ব বিকাশে সংগঠন

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ রয়েছে। এখানে রয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, অঙ্গন, আবৃত্তি মঞ্চ, উত্তরায়ণ, সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন, সব্যসাচী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অব ডিবেট, সিইউ মুনা, বিজ্ঞান ক্লাব, চারণ, রিভারাইন পিপলস, প্রথম আলো বন্ধুসভাসহ বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক সংগঠন।

শাটলে সংগীত

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ট্রেন দেশে একমাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই রয়েছে। চট্টগ্রামের বটতলী স্টেশন থেকে ক্যাম্পাস স্টেশন পর্যন্ত দিনে ১৮ বার যাতায়াত করে এটি। যাত্রাবিরতি করে ছয়টি স্টেশনে। এই শাটল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। শাটলের বগির দেয়াল চাপড়িয়ে ‘ড্রাম’ বাজিয়ে শিক্ষার্থীরা মুখর করে রাখেন পুরো যাত্রাপথ। তাঁদের বলা হয় বগি-শিল্পী। এখানকার বগি-শিল্পীরা জায়গা করে নিয়েছেন দেশের মূলধারার সংগীতাঙ্গনেও। নকীব খান, পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুলসহ অনেক তারকা শিল্পীই এখানে ‘বগি বাজিয়েছেন’! এখনো যেকোনো সময় শাটলে উঠলেই শুনবেন বগি-শিল্পীরা গেয়ে চলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো যায় যায়, হারিয়ে যায়/ উজ্জ্বল, স্বর্ণালি দিনগুলো হায়, হারিয়ে যায় হাওয়ায়…।’

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী অনুপম দাস বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় শাটলে করে এসেছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নেই সুযোগ পেলে এখানে ভর্তি হওয়ার।’

সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পাশেই আছে ঝুলন্ত সেতু

৫২ জনে একজন পাবেন শাটলে চড়ার সুযোগ!

আগামী ২৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হবে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। এবার ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ হাজার ৭৯১ আসনের বিপরীতে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৯ জন আবেদন করেছেন। সেই হিসাবে প্রতি আসনের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৫২ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ ভর্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে প্রতি ৫২ জনের মধ্যে একজন পাবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে ওঠার সুযোগ!

ঝরনা, ঝুলন্ত সেতু ও অন্যান্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের পেছনে পাহাড়ের বুক চিরে ঝিরিঝিরি নেমে এসেছে ঝরনা। এটি ধরে সামনে এগোলে চালন্দা গিরিপথ। এ পথে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়রা চলে যেতে পারবেন সীতাকুণ্ড পাহাড় পর্যন্ত। তবে এর আগে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। এ ছাড়া সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ার ওপর তৈরি করা হয়েছে ঝুলন্ত সেতু। রয়েছে সুনামি গার্ডেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফরেস্ট্রি, লাইব্রেরি চত্বর, গোল পুকুর, শাপলা পুকুর, বুদ্ধিজীবী চত্বর, ছয় পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ মিনার, বিশাল বক্ষ খেলার মাঠ, টেলিহিল, ভিসিহিলসহ ছোট-বড় পাহাড় এবং পাহাড় কেটে বানানো মায়াবী কাটাপাহাড় রাস্তা।

এভাবেই আড্ডা জমে ঝুপড়িতে এবং সুবর্ণজয়ন্তী

সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত আগস্ট থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইভেন্ট খুলেছেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। সেখানে আবেগময় স্ট্যাটাস ও পুরোনো স্মৃতি স্মরণে ছবি শেয়ার করছেন তাঁরা। যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গোলাম রসূল ভূইয়া লেখেন, ‘আহ! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেসব স্মৃতি কী কখনো ভোলা যায়! তাই তো বারবার মনের টানে শরীর সেখানে ছুটে যায়।’

সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন উপলক্ষে ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কামরুল হুদা এ আয়োজনের প্রধান সমন্বয়ক। তিনি বলেন, ‘আগামী সোমবার (১০ অক্টোবর) থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ফি দেড় হাজার টাকা। বর্তমান শিক্ষার্থীদের ফি ৫০০ টাকা।’

প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীউপাচার্যের কথা

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি পরমাণুবিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘ঘুমের মধ্যে আমরা যা দেখি, সেটা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা আমাদের ঘুমাতে দেয় না!’ তাঁর এই বাণীকে ধারণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের এমন স্বপ্ন দেখাতে চাই। যাতে অপার সম্ভাবনাময় তরুণ শিক্ষার্থীরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে মেধা, মনন ও প্রজ্ঞা দিয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ-জাতি বিনির্মাণে অবদান রাখতে পারে। আমি একান্তভাবে আশা করি, অতীতের মতো আগামী দিনগুলোতেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও আধুনিক মানবসম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment