বিকশিত বিকাশ
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
দেড় বছর বয়সে বিকাশের মা মারা যান। মামার বাড়ি জামালপুরেই তাই বেড়ে ওঠা। সেখানে একই স্কুলে ভাইবোনের পড়াশোনা। ইসলামপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে এক মজার ঘটনা ঘটে। তার বড় বোন তখন চতুর্থ শ্রেণিতে। সাধারণ বিজ্ঞান ক্লাসে শিক্ষক পড়িয়েছেন, আলো বাঁকা নলে দেখা যায় না, সোজা নলে দেখা যায়। চতুর্থ শ্রেণির বইয়ে ছবিতে ছিল একটি নলে চোখ দিয়ে অপরপ্রান্তের মোমবাতির দিকে তাকিয়ে আছে একটি মুখ। শ্রেণি শিক্ষক সবাইকে ছবিটি আঁকতে দিয়েছিলেন। বিকাশও এঁকেছিল। দেখে খুবই খুশি হন শিক্ষক। সেই খবর গিয়ে পৌঁছল মামা ইউসুফ আলীর কাছে। উৎসাহটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি কয়েক গুণ। ঢাকা থেকে কিনে আনলেন আঁকাআঁকির সব সরঞ্জাম।
৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় ৩৩টি ছবি দিয়ে ইসলামপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিকাশের একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়। গ্রাম এলাকায় সিনেমা প্রচারের মতো করে সেই প্রদর্শনী নিয়ে মাইকিং হয়েছিল, সিনেমা হলে স্লাইড শো দেখানো হয়েছিল। দর্শক সাড়া ছিল প্রচুর। প্রদর্শনীর সব ছবি বিক্রি হয়ে যায়। দশম শ্রেণিতে হয় দ্বিতীয় চিত্র প্রদর্শনী। ৪০টি ছবি নিয়ে। সেবারও আগের মতো সাড়া। বিক্রি হয়ে যায় সব ছবি।
এসএসি পরীক্ষার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভর্তির খোঁজখবর নিতে আসেন বিকাশ। এক বড় ভাই তার প্রতিকৃতির খাতা দেখে পরামর্শ দেন, ‘তোমার আঁকার হাত ভালো। শুধু প্রতিকৃতি আঁকলে হবে না। পাশাপাশি প্রকৃতির ছবিও আঁকতে হবে।’ একদিন আঁকতে আঁকতে থানার সামনের পুকুর ঘাট, পুকুর ও পুকুরপাড়ের নারিকেলগাছ আঁকছিলেন। পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। রাতে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। মুচলেকায় লেখা ছিল, ভবিষ্যতে কখনো কোনো থানা, সংসদ ভবনসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ছবি আঁকতে পারবে না।
পড়াশোনা করেছেন ঢাকা চারুকলায়। ১৯৯৬ সালে চারুকলা অনুষদে তরুণ চিত্রশিল্পীদের একটি প্রদর্শনী হয়। স্থান পেয়েছিল বিকাশের আঁকা প্রতিকৃতি। দেখে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী তাকে খুঁজে বের করেন। দায়িত্ব দেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের জন্য সাত বীরশ্রেষ্ঠ, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীর প্রতিকৃতি আঁকার। পরে ঢাকার বিভিন্ন স্থাপনা এবং ভবন নিয়ে লেখা বই ‘মনুমেন্ট অ্যান্ড বিল্ডিং এট ঢাকা’র বিভিন্ন স্থানের চিত্র আঁকার দায়িত্বও পড়ে তার ওপর। অথচ এমন একটি কাজের জন্যই তাকে থানায় মুচলেকা দিতে হয়েছিল!
এখন পর্যন্ত আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে বিকাশের পছন্দ প্রতিকৃতি। বঙ্গবন্ধু, রানি এলিজাবেথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকের প্রতিকৃতি করেছেন। প্রতিকৃতি আঁকার বিষয়ে বলেন, ‘আমার প্রথম ছবি আঁকা ছিল একটি নলের সাহায্যে একটি মুখ মোমবাতির আলো দেখছে। তাই মুখের প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা শুরু হয়েছে ছোট বয়সে। পাশাপাশি দেড় বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি। তার মুখের কথা মনে নেই বলে মানুষের মুখ এঁকে সেখানে নিজের মায়ের মুখ খোঁজার চেষ্টা করি।’ জিতেছেন অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য ২০০০ সাল এবং ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড, ২০১৫ সালে চিনে অ্যাওয়ার্ড অব গ্লোবাল কালচারাল আর্টিস্ট এবং এ মাসে জাপানে মনবু-কাগাকু-দাইজিনশো পুরস্কার। জাপানের এই পুরস্কারটাও প্রতিকৃতির জন্যই পেয়েছেন। এক শ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান গিয়েছিলেন। তার গমনের শতবর্ষ উপলক্ষে কবির প্রতিকৃতিই করলেন বিকাশ ‘ব্লোম টাইম অব হানড্রেড ইয়ারস’ শিরোনামে।
২৬ সেপ্টেম্বর জাপানের টোকিও শহরের মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজিয়ামে হয় ২২তম কিও কুবি চিত্রশিল্প প্রদর্শনী। শেষ হয় ২ অক্টোবর। বিভিন্ন দেশের ১৭৯টি শিল্পীর চিত্রকর্ম স্থান পায়। সেখানে জাপানের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে মনবু-কাগাকু-দাইজিনশো পুরস্কার পান শাহজাহান আহমেদ বিকাশ। প্রতিবছর জাপানি শিল্পীদের এ পুরস্কার দেওয়া হলেও এ বছর থেকে তা জাপানের বাইরের শিল্পীদের জন্য উম্মুক্ত করা হয়। প্রথম বছরেই জিতে নেন বিকাশ। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান সফরের শতবর্ষ উপলক্ষে তাকে উপজীব্য করে ছবিটি এঁকেছিলাম। তেলরঙে আঁকা চিত্রকর্মটি ৫ ফুট বাই ৪ ফুট। জমা দিয়েছিলাম প্রদর্শনীর মাসখানেক আগে। ছবিটি প্রদর্শনীতে স্থান পেলেই খুশি থাকতাম। কিন্তু প্রদর্শনীর ১৫ দিন আগে জানানো হয়, ছবিটি নির্বাচিত হয়েছে এবং আমি পুরস্কার পাচ্ছি।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউডার চারুকলা বিভাগের প্রধান বিকাশ। ছবি নিয়েই কাটাতে চান জীবন।