শিক্ষকের চোখে শিক্ষার্থী
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
আমার শিক্ষকতার জীবন ৩৯ বছরে পড়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ বছরের কিছু বেশি। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর চার মাস, ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) ছয় বছর চার মাস শিক্ষকতা করেছি। বর্তমানে উপাচার্য হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বছর শুরু হয়েছে। এখানে আমি ইংরেজি, বাংলা ও নাট্যকলা বিভাগে ঘুরেফিরে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর ক্লাস নিই।
আমার ছাত্রছাত্রী হাজার হাজার, তাদের মধ্য থেকে সামাজিক অর্থে সফল, এমন কতিপয় ছাত্রছাত্রী সম্পর্কে এই রচনায় লিখছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সফল-অসফল ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়, কাজেই এই বয়ানটাও কোনোভাবেই সম্পূর্ণ বা নিরপেক্ষ নয়।
একনেকের একটা সভায় গেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্ব করবেন। সভাকক্ষে ঢোকামাত্রই প্রায় ছুটে এলেন শফিউল আলম। অমায়িক, চিবুকে সামান্য দাড়ি। সালাম দিলেন। বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট সচিব। আলাপে আলাপে শফিউল টিপস দিলেন: ‘যখন আপনার এজেন্ডা আসবে, আপনি ফ্লোর নিয়ে কথা বলবেন। পাস হয়ে যাবে।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) বড় একটি প্রকল্প একনেকের সে মিটিংয়ে পাস হয়েছিল। শফিউল আমার ছাত্র ছিলেন, এটা তো আর আমার মনে নেই, কিন্তু তাঁর মনে আছে। তাঁকে আপনি করে লিখলাম, কারণ তাঁর সঙ্গে তাঁর ছাত্রত্বের পর মাঝখানে কখনো যোগাযোগ হয়নি।
অন্যদিকে সম্পদ বড়ুয়ার সঙ্গে আমার সব সময় যোগাযোগ আছে। সেও শফিউলের বিসিএস সহপাঠী। বর্তমানে সে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব। লেখে। একবার তাকে জাককানইবির একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে নিয়ে এসেছিলাম।
কাজী জিয়াউদ্দিন পুলিশের অপারেশনস বিভাগের এআইজি। ভদ্র ও শিল্পিত তার আচরণ। তার জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তারা তার সততা ও কর্মনিষ্ঠতায় বেজায় খুশি। আমাকে তারা সব সময় তার কথা বলে। পুলিশে আমার দুজন ছাত্রী খুব নাম করেছে। একজন আমেনা বেগম, সে এখন নরসিংদীর এসপি। আরেকজন মাহমুদা বেগম, জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীর সদস্য হিসেবে দেশের বাইরে আছে। ফেসবুকে একবার আমার স্ট্যাটাস দেখে সে জানতে পারে আমি সিলেট যাচ্ছি। তার তখন সিলেটে পোস্টিং। ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সে আমার সঙ্গে সিলেটে দেখা করেছিল।
চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ জসীমউদ্দিনকে আমি পুত্রবৎ জ্ঞান করি। চট্টগ্রাম ছেড়ে এলেও আমার যাবতীয় বিষয়-আশয় ও সম্পর্কের নেটওয়ার্কগুলোর দেখাশোনা করার দায়িত্ব তার। তারই সহকর্মী এবং আমার ছাত্র সাদত্ জামান খানকে আমি ‘কবি’ ডাকি তার উদাসীন স্বভাবের জন্য। যদিও জীবনে নাকি সে একখানা কবিতাও লেখেনি। এদেরই আরেক সহপাঠী মেহরাব রহমান এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ পরিচালনার সময় আমি আমার এক মহা বাউন্ডুলে ছাত্রকে শিক্ষক হিসেবে চাকরি দিয়েছিলাম। সে বাংলাদেশের জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিল। রফিকুল ইসলাম, লেখে ইংরেজিতে, ডেইলি স্টার-এ। শুধু শিক্ষক বানিয়ে ছেড়ে দিইনি, বিয়েও করিয়েছি। এখন সে দুই কন্যার জনক, সুন্দর সংসার করছে। তবে বলি, ‘রফিক, তোমারে টিচার বানাইয়া আমি বাংলাদেশের দাবার খুব ক্ষতি করলাম।’ সে মুচকি হাসে।
আমার সবচেয়ে বড় বাউন্ডুলে ছাত্র হলো পার্থ বড়ুয়া, যে এখন নামকরা গায়ক ও অভিনয়শিল্পী। রফিক চালচুলোহীন থাকলেও তার ইংরেজিটা ছিল, আর পার্থের ছিল ইংরেজিতে মহাজ্ঞান। পড়েছিলও টিউটোরিয়ালে আমার সঙ্গে। মনে আছে, প্রতিটা টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমি তাকে বকতে বকতে হয়রান হয়ে যেতাম। আসলে যার রক্তে লেগেছে গানের দোলা, তার কাছে ইংরেজি কী!
আমার দুজন খুব প্রতিভাময়ী ছাত্রী মাহী-নূর কুদসী ইসলাম এবং দুর্দানা মতিন তাদের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। আমার মনে হয়, একান্তই নারী হওয়ার কারণে। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সভাপতি থাকাকালীন এ দুজনের প্রভাষক হিসেবে চাকরি হয়। তারপর তারা কালক্রমে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। ভার্জিনিয়া উলফের একটি রচনায় এ রকম কথা আছে যে শেক্সপিয়ারের যদি কোনো যমজ বোন থাকত এবং শেক্সপিয়ারের মতোই প্রতিভাসম্পন্ন হতো, তাহলেও সে কেবল নারী হওয়ার কারণে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেত।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাকসেস স্টোরি হলো রাসেলুল কাদের নামক ছাত্রটি। সে এখন নোয়াখালীর কোনো একটা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ত এখনকার অভিনেত্রী অপর্ণা, চাটগাঁইয়া ভাষায় নির্মিত টিভি-ফিল্মে অভিনয় করে খুব নাম করেছে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের এক ছাত্রীর কথাও বলতেই হয়—সাইদা জিন্নাত। আমার খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল। সে সৈয়দ মুজতবা আলীর নাতনি। দাদার রসবোধ পুরোপুরিই সে পেয়েছে।
লেখক: মোহীত উল আলম। উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়