স্বপ্ন সম্ভাবনা
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
সবুজ পাহাড়ের কোলে ১৮৩ একরের বিশাল ক্যাম্পাস। যেখানে ডানা মেলে প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পাশে চোখে পড়বে এই শিক্ষাঙ্গন—চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।
১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল চুয়েট। পরে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি) হিসেবে এবং সর্বশেষ ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমানে এখান থেকে স্নাতক ছাড়াও স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। ১০টি বিভাগে পড়ছেন ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনেকে কাজ করছেন দেশে-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
চুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই হলে থাকেন। পাঁচটি আবাসিক হলের মধ্যে চারটি ছেলেদের ও একটি মেয়েদের জন্য। হলজীবনের আনন্দের কথা বলতে গিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের রাফসান জানি বলেন, ‘ক্লাসমেট, সিনিয়র-জুনিয়র সবাই একসঙ্গে আবাসিক হলে থাকার অভিজ্ঞতা সারা জীবন মনে থাকবে।’
চুয়েট ক্যাম্পাসে আড্ডার গাড়ি চলে ‘বিরতিহীন’! ক্যানটিন, লাইব্রেরি, শহীদ মিনার, চায়ের দোকান কিংবা গোলচত্বরে সকাল থেকে রাত অবধি ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট জটলা চোখে পড়ে। রাত বাড়লে সে জটলা চলে যায় হলে যার যার ঘরে কিংবা বারান্দায়। পরীক্ষা, পড়ার চাপের পাশে এই আড্ডাই তো হবু প্রকৌশলীদের চাঙা রাখে। আলাপের বিষয়গুলোও মজার। কে কবে ব্যবহারিক পরীক্ষায় উল্টো দিক থেকে গণনা করে উত্তর মিলিয়েছেন, শীতের দিনে কারও জন্মদিনে কাকে কীভাবে পানিতে ভেজানো হয়েছে, সবাই মিলে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়…ইত্যাদি। শেষ বর্ষের রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘ক্যাম্পাসে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকাটা কিন্তু আগামী দিনগুলোতে কর্মজীবনে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে কাজ করার একটা প্রশিক্ষণও। হলের আনন্দ-উচ্ছ্বাস আমাদের জীবনের না পাওয়াগুলো ভুলিয়ে দেয়, সামনে চলার সাহস জোগায়।’
প্রাক্তন ও বর্তমান সব শিক্ষার্থীই বলেন, তাঁদের কাছে চুয়েট একটা পরিবারের মতো। এই ‘পরিবারের’ টানে পুরোনো ছাত্ররাও সুযোগ পেলেই ক্যাম্পাসে চলে আসেন। প্রাক্তন ছাত্র, ৪০তম ব্যাচের মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা একবার হলেও মনে হয়। এখনকার ছকে বাঁধা জীবনের সঙ্গে চুয়েটের জীবনকে তুলনা করলে আবারও ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।’
চুয়েটের পরিবেশ পড়াশোনার জন্য খুব ভালো—এমনটাও বিশ্বাস করেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। শেষ বর্ষের শাহরিয়ার শাকিল বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে যখন আলো-ছায়ার মধ্য দিয়ে পিচঢালা পথটা দিয়ে ক্লাসে যাই, তখন মনে হয় সপ্তাহে সাত দিন এভাবে ক্লাসে যেতে হলেও কোনো আক্ষেপ থাকত না।’ চুয়েটে বর্তমানে ২০০ জন শিক্ষক আছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণামূলক কাজগুলোতেও তাঁরা অংশগ্রহণ করেন। চুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সজল চন্দ্র বণিক বলেন, ‘গবেষণা বা পড়ালেখার যেকোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সমস্যা নিয়ে এলে আমরা খুব আন্তরিকতা নিয়েই তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করি।’
ক্যাম্পাসে গবেষণার কাজ নিয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গবেষণায় একবার ডুবে গেলে কখন যে দিন থেকে রাত হয়ে যায়, টেরই পাই না। রোবটিকস ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রসহ দেশে যেসব প্রযুক্তি এখনো বিকশিত হয়নি, শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
এখানে পড়াশোনা ও গবেষণার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও শিক্ষার্থীরা বেশ এগিয়ে আছেন। ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। সংস্কৃতি চর্চার জন্য জয়ধ্বনি, বিতর্ক চর্চার জন্য ডিবেটিং সোসাইটি, পরিবেশ রক্ষার কর্মকাণ্ডের জন্য রয়েছে গ্রিন ফর পিস সংগঠন। এ ছাড়া রয়েছে ক্যারিয়ার ক্লাব, ফিল্ম সোসাইটি, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও সাংবাদিক সমিতি। অন্যদিকে রোবট-ইলেকট্রনিকস গবেষণার জন্য রোবো মেকাট্রনিকস বাংলাদেশ ও অ্যাসরোর মতো সংগঠনগুলোও কাজ করে যাচ্ছে। এসব সংগঠনের নানা আয়োজনে প্রায় সারা বছরই মেতে থাকে ক্যাম্পাস। তারুণ্যের জয়যাত্রা নিয়ে প্রতিবছরই ডিবেটিং সোসাইটি আয়োজন করে প্রথম আলো-তারুণ্য উৎসব। গ্রিন ফর পিস আয়োজন করে ‘গ্রিনডে’। আর বিভিন্ন সময়ে রোবটদৌড়, রোবটযুদ্ধের মতো অনুষ্ঠানগুলো তো আছেই।
চুয়েটের শিক্ষার্থীদের জন্য বন্দরনগরের কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণশিল্পের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগটা বেশি। এ ছাড়া অবস্থানের কারণেই চুয়েট থেকে সহজেই ঘুরে আসা যায় কাপ্তাই, সেন্টমার্টিনস, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে। এসব সুযোগ কাজে লাগাতে দ্বিধা করেন না চুয়েটের শিক্ষার্থীরা। অবসর কিংবা ছুটি পেলেই ঘুরে আসেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা পর্যটনকেন্দ্র থেকে। শেষ বর্ষের খন্দকার গোলাম মোর্শেদ বলেন, ‘বিকেলে সময় পেলেই প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। বন্ধুদের নিয়ে কখনো চলে যাই কর্ণফুলী নদীর তীরে, কখনোবা অচেনা কোনো পাহাড়ের দিকে।’
বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হবে
রফিকুল আলম, উপাচার্য, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চুয়েটকে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার প্রচেষ্টা চলছে। আমাদের স্নাতকেরা দেশে-বিদেশে ভালো অবস্থানে আছে। ২০২১ সালের মধ্যেই চুয়েটের শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া খুব শিগগির চুয়েটের প্রস্তাবিত আইসিটি ইনকিউবেটরের কাজ শুরু হবে। এতে করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই আউটসোর্সিং শুরু করতে পারবে। চুয়েট পরিবারের সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়।’