মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ‘হার্ট টু হার্ট’
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
এ বছর জুলাই মাসের ১৫ তারিখ। উড়িরচর থেকে ফিরছিল ৫১ জন মেডিকেল শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকের একটি দল। মাঝপথে ট্রলারের ইঞ্জিন গেল বিকল হয়ে। সঙ্গে ৫ নম্বর বিপদ সংকেত। উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে ট্রলার প্রায় ডুবু ডুবু। মেডিকেল কলেজের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হয়তো সে দিনই ঘটে যেত, যদি না ভাগ্যদেবতা সঙ্গে থাকতেন। ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় সমুদ্রের চ্যানেলে আটকে থাকার পর উদ্ধার হওয়ার গল্পটা আরও রোমহর্ষক। সে কথা থাক, আজ বলব সেই ট্রলারের যাত্রীদের কথা। দেশের আনাচকানাচে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন একদল তরুণ—তাঁরা ‘হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য।
দুর্গম এলাকার মানুষদের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে এই সংগঠন। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় বিনা মূল্যে ৪১টি মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করেছে এ সংগঠন। প্রতিটি ক্যাম্পে ইন্টার্নি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন। ক্যাম্প সমন্বয়কারী কেয়া দাস গত আগস্ট থেকে এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে অংশ নিয়েছেন সাতটি ক্যাম্পে। তিনি বলেন, ‘এ দেশে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে লোকজন চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না। তাই আমরা চিকিৎসকেরাই তাঁদের কাছে গিয়ে সেবা দিয়ে আসি।’ জানালেন, দুর্গম এলাকার রোগীদের তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হতে সহায়তা করেন, প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের দায়িত্বও নেন। ক্যাম্পে শুধু চিকিৎসাসেবা দিয়েই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয় না, রোগীদের হাতে ওষুধও তুলে দেন বিনা মূল্যে। দুর্যোগকবলিত এলাকায় এই তরুণেরা ত্রাণ পৌঁছে দেন। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাত হানার পরও সদলবলে তাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন ভোলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা তজুমদ্দিনে।
এসবের পাশাপাশি আরও একটা দিক নিয়ে হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশ কাজ করে থাকে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র ফাহাদ মুনতাসীর বলেন, ‘মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের “সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট” দিই আমরা। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে ১০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর আগেও এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কারণ, মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের জন্য চাপটা একটু বেশি। এই চাপ নিতে না পেরে অনেকেই ভেঙে পড়েন। এত সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের এমন পরিণতি হোক, এটা আমরা কেউ চাই না। তাই তাঁদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে সাহায্য করার দিকে আমরা বিশেষভাবে জোর দিয়েছি।’
সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ সংগঠনটি নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। তিনি বলছিলেন, ‘প্রথমে যখন তাঁরা আমার কাছে এল, আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। এ ধরনের কাজ নিয়ে আমার কাছে সাধারণত কেউ আসে না। পরে মনে হলো, ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা গেলে সেটা ভালোই হবে। তখন থেকে এ পর্যন্ত খুব ভালোভাবে কাজ চলছে। মাত্র তো শুরু। আমার বিশ্বাস—ভবিষ্যতে যখন এই সংগঠন আরও পরিচিতি পাবে, তখন অনেক বড় পরিসরে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।’
ভবিষ্যৎ নিয়ে ফাহাদ মুনতাসীরের চিন্তাভাবনাও বেশ বিস্তৃত। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্বপ্ন দেখি—দেশের প্রতিটি জায়গায় একটি করে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার। মানুষ যেন তাঁদের যেকোনো মানসিক সংকটে দ্রুত কাউন্সেলিং পায়। আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মতো মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখতে চাই। যেন একই দিনে দেশের সব উপজেলায় একযোগে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারি।’
এক পা দুই পা করে চলতে থাকা এই সংগঠনের নির্বাহী সদস্যের সংখ্যা এখন ৩০। আর সব মেডিকেল মিলিয়ে মোট সদস্য প্রায় ৫০০। সঙ্গে আছেন ২০০ জন ডাক্তার। পদেশের প্রায় প্রতিটি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের বহু শিক্ষক, চিকিৎসক এ সংগঠনটির সঙ্গে কাজ করছেন। ফাহাদ বলেন, তাঁর দল এখন পর্যন্ত ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেছে ৫০ জনেরও বেশি মানুষের। আবার ১০ জন গরিব মেডিকেল ছাত্রছাত্রীকে এককালীন শিক্ষাবৃত্তিও দিচ্ছেন তাঁরা।
উড়িরচর থেকে ফেরার পথে সেই ট্রলারে বাকিদের সঙ্গে ফাহাদও ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমরা কেউ ভাবিনি যে বেঁচে ফিরতে পারব। কীভাবে যেন বেঁচে গেলাম। আসলে দেশের মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে গিয়ে কষ্টকর অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। কিন্তু কোথাও গিয়ে মানুষের সেবা দিতে পারার মধ্যে যে আনন্দ, সেটার লোভে হলেও বারবার কাজের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে আর ভয় হয় না।’